প্রধানমন্ত্রী উপহারের ঘরে ফাটল, নেই বিদ্যুৎ ও পানির সুবিধা

ছয় বস্তা বালিতে একবস্তা সিমেন্ট, খুঁটিতে দেড়ফুটের রড

মুজিববর্ষে গৃহহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলো তৈরিতে নানা অনিয়মের খবর পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের পটিয়ায়। আশ্রয়ন প্রকল্পের এসব নির্মিত ও নির্মাণাধীন ঘরগুলোতে ইতিমধ্যে ফাটল ধরেছে। পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীও। ফলে এ নিয়ে নানা সমালোচনা চলছে উপজেলাজুড়ে। আশ্রয়ন প্রকল্পের এসব ঘর একেবারে ভেঙে না পড়লেও কাজে নিম্নমানের অভিযোগ রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে।

এদিকে পটিয়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক আশ্রয়ণ প্রকল্পের হস্তান্তর করা ঘরগুলো যারা পেয়েছেন, তারাও সেই ঘরগুলোতে বসবাস করতে পারছেন না বলে জানা গেছে। সম্প্রতি উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, অধিকাংশ ঘরের ভেন্টিলেটর ভাঙা, কোনোটির মেঝেতে ফাটল আবার বেশিরভাগ ঘরের নিম্নমানের টিনের দরজা-জানালা বেঁকে যাওয়ায় সেগুলো খুলতেও রীতিমতো দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এসব ঘরের ছাউনিতেও ব্যবহার করা হয়েছে অতি নিম্নমানের কাঠ। সবগুলো ঘর বাইরে সাদা রং করলেও বেশিরভাগ ঘরের ভেতরের অংশে রং নেই বললেই চলে। আবার কিছু জানালার বাইরে রঙ করা হলেও ভেতরের অংশে মরিচা ধরেছে। করা হয়নি সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থাও। তাই ঘর পাওয়া এসব গৃহহীন মানুষের দুর্ভোগেরও অন্ত নেই। তবে ঘরগুলোর বাইরের দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। ঘরগুলোতে লাগানো নীল-সবুজ রংয়ের ঢেউটিনগুলো পাহাড়ি এলাকাটিকে রঙিন করেছে।

আশ্রয়ন প্রকল্পের অনেক ঘরে ইতিমধ্যে ফাটল ধরেছে।
আশ্রয়ন প্রকল্পের অনেক ঘরে ইতিমধ্যে ফাটল ধরেছে।

নির্মানাধীন ঘরে কর্মরত রাজমিস্ত্রিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ‘নিয়ম অনুযায়ী কাজের কোনকিছু হচ্ছে না। আমরা যদি কাজ নিয়ম অনুযায়ী করতে চাই, তাহলে বলা হয় বিধিনিষেধ আছে ওপরের। তাই তারা যেভাবে বলছে, সেভাবেই আমরা করছি।’

তাদের সাথে কথা বলে আরও জানা গেছে, পাকা ঘরের নিয়ম অনুসারে প্রতি চার বস্তা বালির সাথে এক বস্তা সিমেন্টসহ প্রয়োজনীয় কংক্রিট মেশানো হয়। অথচ সেটা মানা হচ্ছে না। ছয় বস্তা বালির সাথে একবস্তা সিমেন্ট আর নিম্নমানের কংক্রিটের গুড়া যুক্ত করা হচ্ছে। অপরদিকে সেমিপাকা এসব ঘরের ইটের খুঁটিতে লোহার রড ব্যবহার করার কথা থাকলেও তা না করে শুধুমাত্র খুঁটির উপরিভাগের অংশে দেড় ফুটবিশিষ্ট একটি লোহার টুকরা গেঁথে দেওয়া হচ্ছে— যা দেখলে যে কারও মনে হবে বুঝি খুঁটিতে লোহার রডই ব্যবহার করা হচ্ছে।

কাজ চলাকালে খুঁটির ওপর একজন শ্রমিককে দেখা যায়, খুঁটির ওপর গেঁথে দিচ্ছেন একটি ছোট রড। এই প্রতিবেদক সেই রডটি হাত দিয়ে তুলতে বললে দেখা যায়, মাত্র দেড় ফুটের একটি ছোট রড। এমন অবস্থা কেন— জিজ্ঞেস করতেই উত্তর মিলল, আমাদের যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে কাজ করছি।

শুধুমাত্র খুঁটির উপরিভাগের অংশে দেড় ফুটবিশিষ্ট একটি লোহার টুকরা গেঁথে দেওয়া হচ্ছে।
শুধুমাত্র খুঁটির উপরিভাগের অংশে দেড় ফুটবিশিষ্ট একটি লোহার টুকরা গেঁথে দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে এরই মধ্যে ২৩০টি ঘরের মধ্যে ২০০টি ঘর ভূমি রেজিস্ট্রিসহ ভূমিহীন মানুষের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে বসবাসও শুরু করেছেন তারা। প্রত্যেকে দুই শতক জমির ওপর নির্মিত এসব ঘরের মালিক হবেন। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে রয়েছে রান্নাঘর, দুটি থাকার ঘর, একটি বাথরুম ও ঘরের সম্মুখে খালি জায়গা।

উপজেলার হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের দক্ষিণ হুলাইনের গৃহহীন নারী নুর বেগম জানান, ‘নেই পানি নেই বিদ্যুৎ। তার ওপর সওয়ার হয়েছে ঘরের ফাটল।’ নুর বেগম ফাটল ধরা ঘরের ফ্লোর দেখিয়ে বলেন, ‘জেলা প্রশাসনের একটা টিম পরিদর্শনে আসার খবর পেয়ে ঠিকাদার ফাটল ধরা ফ্লোরে কাজ করে দিয়েছেন কয়েকদিন আগে।’

উপজেলার কুসুমপুরা ইউনিয়নের আরেক গৃহহীন গ্রাম চৌকিদার ইলিয়াস বলেন, ‘আমার ঘরের বাথরুমের কমোড ভেঙে গেছে। ঘরের ফ্লোর ও জানালায় ফাটল শুরু হয়েছে। ফাটলগুলো নিয়ে আমরা ঠিকাদারের কাছে অভিযোগ করার পর তারা ঠিক করে দিয়ে গেছেন।’

এ সময় শোভনদন্ডী ইউনিয়নের লাওয়ারখীল এলাকার গৃহহীন নারী হোসনে আরা বলেন, ‘পটিয়া সদর থেকে লোক এসে বিদ্যুতের সংযোগ দেবে বলে ৫৬৫ টাকা করে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেলেও আর তাদের দেখা মেলেনি। আমরা ছোট ছোট সন্তান নিয়ে চরম ভোগান্তিতে আছি পানি ও বিদ্যুতের কারণে।’

মোজাম্মেল হোসেন নামের আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাদের ঘর ছিল না। এখন ঘর পেয়ে খুশি হয়েছি। এজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। কয়েকদিন আগে মিটার লাগিয়েছে, তবে এখনও বিদ্যুৎ সংযোগ লাগেনি। পুরো ঘরের ফ্লোর সবই ফাটা। এছাড়া খাবার পানির সংকটে আছি। পাশের এলাকা হতে পানি আনতে গেলে আমাদের তারা পানি দিচ্ছে না।’

এসময় ঘর পাওয়া পরিবারগুলোর অনেকেই জানার, এখানকার ঘরগুলো নতুন হলেও পানি ও বিদ্যুতের সুব্যবস্থা না থাকায় অনেক দূরে গিয়ে পাশের গ্রাম থেকে খাবার পানি আনতে হচ্ছে। ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় তীব্র গরমে ঘরে থাকাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া অনেক ঘরে বাথরুমের কমোড ও দরজাগুলোও লাগানো হয়েছে উল্টো করে। কয়েকটি ঘরে ছাউনি দিয়ে বৃষ্টিতে পানিও ঢুকছে। টানা বৃষ্টিতে পাহাড়ি মাটি আর পানি মিলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

রশিদাবাদের আরেক গৃহহীন সাইফুল ইসলাম জানান, পার্টির লোকজন আমাদেরকে ১০ হাজার টাকা করে দিতে চাপ দিচ্ছে। তারা বলছেন তোমাদের জন্য আমরা লবিং করে ঘরগুলো এনে দিয়েছি। টাকা দিয়েছেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে সটকে পড়েন অন্যদিকে।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ভূমিহীনদের ঘর উপহার দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয় দুই দফায় । চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় এ ধরনের ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। পটিয়া উপজেলায় এরকম ২৩০টি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৬০টি, বাকিগুলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মাণ করা হচ্ছে।

পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নের সাপমারা, গুচ্ছগ্রাম ও হাইদগাঁও পাহাড়ি এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রথম ২০০ ঘরের প্রতিটি নির্মাণের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। পরের ৩০টির ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা করে। আকবর নামে আনোয়ারা উপজেলার সরকারি দলের এক ঠিকাদার প্রথম ৩০টি ঘরের নির্মাণ কাজ করেন। পরে পটিয়ার সরকারি দলের শেখ বেলাল ৪০টি, পটিয়া উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কচুয়াই ইউনিয়নের এনাম মজুমদার ও ভাটিখাইন ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি নাজিম উদ্দীন ৮০টি ও জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের নাইখাইন গ্রামের মো. হাসান ৫০টি ঘর নির্মাণের কাজ পান।

গত ৫ জুলাই অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এলএ) মাসুদ কামাল নির্মাণাধীন ঘরগুলো পরিদর্শন করার সময় তিনিও ফ্লোরে ফাটল ও পানি-বিদ্যুতের সমস্যার বিষয়ে অবহিত হন।

এদিকে শনিবার (১০ জুলাই) দিবাগত রাতে উপজেলার পূর্ব হাইদগাঁও এলাকায় ভূমিহীনদের জন্য নির্মিত বেশ কিছু ঘরে ভাঙচুর চালিয়েছে একদল দুর্বৃত্ত। তারা প্রধানমন্ত্রীর নামফলকও গুঁড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) দুপুরে ঝটিকা সফরে পটিয়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেখতে আশ্রয়ণ প্রকল্পে যান চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাজমুল আহসান, পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমদ, আরডিসি সুজন চন্দ্র রায়, এনসিডি ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ রানা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রাজিব হোসেন, পটিয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সুপ্তশ্রী সাহা প্রমুখ।

জেলা প্রশাসক পটিয়ায় দুর্বৃত্তদের হামলায় ক্ষতিগ্রস্থ আশ্রয়ণের ঘরগুলো পরিদর্শন করে ১৫-২০ জনের একটি কমিটি গঠন ও নিয়মিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা, হামলাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন।

বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে পটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘মুজিববর্ষে ভূমিহীনদের দেওয়া ঘরগুলো প্রধানমন্ত্রীর ঘর হিসেবে পরিচিত। এগুলো নির্মাণে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেওয়া হয়েছে। ঘরগুলো তৈরি হলেও লোকজন না উঠায় এতোদিন বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎ না যাওয়ায় পানির ব্যবস্থাও করা সম্ভব হয়নি। এখন লোকজন ঘরগুলোতে উঠতে শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে প্রত্যেকটি ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া শুরু হয়েছে। পানির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!