নিষিদ্ধ শূকর বর্জ্যের চালান ছাড়াতে মরিয়া সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট

খালাসের অনুমতি দেবে না চট্টগ্রাম কাস্টমস

নিষিদ্ধঘোষিত শূকরের হাড়-বর্জ্যযুক্ত ‘ফিশ ফিড ও মিট অ্যান্ড বোন মিল’ আমদানি করে ওই চালান কাস্টমস থেকে ছাড়িয়ে নিতে জোর প্রচেষ্টায় আছে আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। কাস্টমস থেকে ছাড় নিতে না পেরে অনেক আমদানিকারক হাইকোর্টেরও শরণাপন্ন হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার চালান বিদেশে ফেরত পাঠানোর আবেদনও করছেন।

জানা গেছে, সম্প্রতি পাঁচটি চালান ফেরত পেতে মামলা দায়ের করা হয়েছে হাইকোর্টে। অপরদিকে ১১টি চালান বিদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য কাস্টমসে আবেদন করা হয়েছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে নিষিদ্ধ এ পণ্যের ৩৬টি চালান আটক রয়েছে। ফিশ ফিড (মাছের খাবার) আমদানির নামে শূকরের হাড় ও বর্জ্যযুক্ত প্রাণীখাদ্য (মিট অ্যান্ড বোন মিল) নিয়ে আসার ঘটনায় চালান খালাস না দিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। এ সংক্রান্ত পণ্য খালাস না দেওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলমকে লিগ্যাল নোটিশও দিয়েছেন অনেক আমদানিকারক।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে ফিশ ফিড ষোষণা দিয়ে আমদানিকৃত চালানটিতে একাধিক রাসায়নিক পরীক্ষায় বোভাইন অ্যান্ড প্রোসিনের (শূকরজাত দ্রব্য) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমদানি নিষিদ্ধ এই পণ্য কোনভাবেই খালাসের অনুমতি দিচ্ছে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

যেসব আমদানিকারক জড়িত
কাস্টমস সূত্র জানায়, আমদানিকারক আয়েশা কর্পোরেশন, স্প্রেক্টা হেক্সা ফিড লিমিটেড, ঢাকার মগবাজারের প্রমিক্স এগ্রো এন্ড ফিড প্রোডাক্টস, ফিশটেক বিডি লিমিটেড,ময়মনসিংহের এক্যুয়াটেক এগ্রো বাংলাদেশ লিমিটেড এডভান্স এগ্রোলেক বাংলাদেশ, কোয়ালিটি ফিডস লিমিটেড. আরআরপি এগ্রো ফার্ম, ইন্টার এগ্রো বিডি লিমিটেড ম্যাগনিফাই এগ্রো লিমিটেড সিরাজগঞ্জের শিসাম ফিড লিমিটেড ও মিশাম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ, ভিএনএফ এগ্রো লিমিটেড, এমকেএ হ্যাচারি, দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ঘোষিত এসব পণ্য আমদানি করে আসছে।

যেসব সিএন্ডএফ জড়িত
ঢাকা চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ১৩টি আমদানিকারকের পক্ষে চালানগুলো খালাসের দায়িত্বে আছে সিএন্ডএফ এজেন্ট এশিয়া এন্টারপ্রাইজ, বাংলা লাইনার এজেন্সিজ, হায়দার ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আল ফাহিম বিডি, স্বাধীন এন্টারপ্রাইজ, সামিট এন্টারপ্রাইজ, বাংলাদেশ শিপিং এজেন্সিস প্রাইভেট লিমিটেড, রিলায়েবেল ট্রেডিং এজেন্সিস লিমিটেড এবং এএমবিই ক্লিয়ারিং লিমিটেড। এর মধ্যে চট্টগ্রামের সিএন্ডএফ এজেন্ট এশিয়া এন্টারপ্রাইজ ও জে এইচ ট্রেডিং ৮টি চালানের পণ্য খালাসের দায়িত্বে আছে।

কঠোর অবস্থানে কাস্টমস হাউস
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে রাসায়নিক পরীক্ষায় শূকরের হাড় ও বর্জ্যের অস্তিত্ব পেলে আটক থাকা একই পণ্যের নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি) পাঠানো হয়। গত ১ জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঠানো প্রত্যেকটি নমুনা প্রতিবেদনে শূকরের হাড় ও বর্জ্যযুক্ত প্রাণি খাদ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়। অধিকতর রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে নমুনা উত্তোলন করে চট্টগ্রামে পোল্ট্রি রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং সেন্টারেও পাঠানো হয়ে থাকে।

কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকতর পরীক্ষার জন্য সর্বোচ্চ তিনটি ল্যাবে পাঠানো হয় নমুনা। এ ক্ষেত্রে দুই ল্যাবের ফলাফল একই হলে চালানটি ছাড় বা আটক রাখা হয়।

কাস্টম কমিশনার মো. ফখরুল আলম বলেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আমদানির মাধ্যমে দি ইম্পোটার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স কন্ট্রোল অ্যাক্ট ১৯৫০ এবং আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ এর অনুচ্ছেদ ১৭, পরিশিষ্ট ১ এর খ অংশের বিধান লংঘন করেছে আমদানিকারক। কাস্টম কর্তৃপক্ষ সরকারি সেই পলিসি বাস্তবায়ন করছে।

চালান আটক থাকা প্রমেক এগ্রোর চিফ কমার্শিয়াল অফিসার ইলিয়াছ হোসেন রাজু বলেন, আমরা পণ্য ছাড় নেওয়ার জন্য হাইকোর্টে শরণাপন্ন হয়েছি। কারণ কাস্টমস হাউস থেকে চালান ছাড় নিতে আমরা ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব খাদ্যে মুরগি ও মাছ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে এটি মানবস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। এবার কঠোর নজরদারির আওতায় এসেছে সিন্ডিকেটটি। গত ৬ মাসে মিট অ্যান্ড বোন মিলের (শূকরের বর্জ্য, হাড় ও মাংসযুক্ত মাছ ও মুরগির খাবার) ৩৬টি চালান আটক করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। এসব চালানে একাধিকবার রাসায়নিক পরীক্ষার পর মিট অ্যান্ড বোন মিলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে যাওয়া এসব চালান খালাস নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টরা। চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিজস্ব ল্যাব, চট্টগ্রামের পিআরটিসি (পোল্ট্রি রিসার্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার) এবং ঢাকার আইসিডিডিআরবিতে একাধিকবার পণ্যগুলোর রাসায়নিক পরীক্ষায় শূকরের বর্জ্যযুক্ত খাবারের প্রমাণ মিললেও পণ্যগুলো খালাস নিতে ভিন্ন পথে হাটছে আমদানিকারকরা।

আটক হওয়া চালানের মধ্যে ১১টি চালানের নমুনা পুনরায় পরীক্ষার জন্য হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে আমদানিকারকরা। গত ১৪ আগস্ট দায়ের হওয়া ওই মামলার রায়ে চালানগুলোর নমুনা বিসিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগারে (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ), বিসিএসআইআর ও আইসিডিডিআরবি পুনরায় পরীক্ষা করার নির্দেশ দেওয়া হয় বলে নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একটি সূত্র। ওই আদেশ অনুসারে কমপক্ষে তিনটি ল্যাবে পরীক্ষা করে দুটিতে শূকর বর্জ্যর অস্তিত্ব না পাওয়া গেলে চালানগুলো ছেড়ে দেওয়া হবে। দুটি পরীক্ষায় মিল পাওয়া গেলে ওসব পণ্য সরাসরি ধ্বংস করা হবে। ইতিমধ্যে কয়েকটি চালান ধ্বংস করাও হয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার।

এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!