বন্দরে ফিশ ফিডের নামে শূকরের মাংস, ১১ চালানের ভাগ্য আদালতের হাতে

চক্রের হোতা এশিয়া এন্টারপ্রাইজ

ফিশ ফিড আমদানির ঘোষণা দিয়ে আমদানি নিষিদ্ধ শূকরের মাংস বর্জ্য ও হাড়যুক্ত মিট অ্যান্ড বোন মিল নিয়ে আসার ঘটনা শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে গত ৩ মাসে আটক এরকম ১৮ টি চালানের নমুনা ৩টি প্রতিষ্ঠানে আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষার পর ওই চালানগুলোতে শূকরের মাংস ও হাড়ের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমদানি নিষিদ্ধ ও ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকা এসব পণ্য আমদানি বছরের পর বছর চলে আসছিল, যা স্বাস্থ্যের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ।

বন্দর থেকে কন্টেইনার খালাস নিতে আমদানিকারকরা হাইকোর্টে রিট দায়ের করে। ১১টি চালানের বিষয়ে রিট দায়েরের পর হাইকোর্টের নির্দেশে ওই চালানগুলো থেকে পুনরায় নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য বিসিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগারে (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) পাঠানো হয়।

সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বেঞ্জে এসব রিট মামলার বিষয়ে আপিল শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। ওই শুনানির রায়ের ওপর নির্ভর করছে ১১টি চালানের ভবিষ্যৎ।

গত ১৪ আগস্ট হাইকোর্টে ১১টি মামলা দায়েরের পর আরো একটি চালানের বিষয়ে নতুন করে রিট মামলা দায়ের করেছে এক আমদানিকারক।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের আইন শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, ফিশ ফিড আমদানির ঘোষণা দিয়ে মিট এন্ড বোন মিল নিয়ে আসার ঘটনায় আটককৃত চালানগুলোর মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ১১টি রিট মামলা দায়ের করে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। ওই রিট মামলার আলোকে ইতোমধ্যে চালানগুলোর নমুন সংগ্রহ করে বিসিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগারে (বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ) পাঠানো হয়েছে। রিট মামলাগুলোর বিষয়ে ৯ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বেঞ্জে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

আমদানি নিষিদ্ধ মিট এন্ড বোন মিল
২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ-২ অধিশাখা থেকে মিট এন্ড বোন মিল আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়। ওই মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব নিগার সুলতানা স্বাক্ষরিত ওই আদশে বলা হয়, দেশের পশুখাদ্যের গুণগত মান, দাম সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি বিচেনায় নিয়ে প্রাণী খাদ্যে ঝুকিপূর্ণ খাদ্য উপকরণ মিট অ্যান্ড বোন মিল, প্রাণিজাত প্রোটিন মিল, প্রোটিন কনসেনট্রেট বিদেশ থেকে আমদানি করা পুরোপুরি আবশ্যিকভাবে নিষিদ্ধ হল।

এরপর নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ থেকে সকল কাস্টম হাউজ কমিশনারকে দেওয়া চিঠিতে মিট এন্ড বোন মিল, প্রোটিন মিল, প্রোটিন কনসেনট্রেট আমদানি এবং বন্দর থেকে খালাস বন্ধের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ওই প্রতিষ্ঠানের সচিব মোকাম্মেল হক স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তবুও বেপরোয়া দুস্কৃতিকারীরা
মিট অ্যান্ড বোন মিল আমদানি নিষিদ্ধ হলেও থেমে নেই দুস্কৃতিকারীদের অপতৎপরতা। ফিশ ফিড আমদানির ঘোষণা দিয়ে নিয়ে আসছে মিট অ্যান্ড বোন মিল। বর্তমান কমিশনার ফখরুল আলম যোগদানের পর চোরাচালান বন্ধে তার কঠোর অবস্থানের কারণে ধরা পড়ছে একের পর এক চালান।

চক্রের হোতা এশিয়া এন্টারপ্রাইজ
চট্টগ্রাম বন্দরে যে ১৮টি চালান আটক করা হয়েছে তার ৮টি খালাসের দায়িত্বে রয়েছে চট্টগ্রামের সিএন্ডএফ এজেন্ট এশিয়া এন্টারপ্রাইজ। গত ১৪ আগস্ট হাইকোর্টে যে ১১টি চালানের বিষয়ে রিট মামলা দায়ের হয়েছে তার মধ্যে ৭টি চালানের খালাসের দায়িত্বে আছে এশিয়া এন্টারপ্রাইজ।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের সংশ্লিষ্ট একাধিক শাখায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিট অ্যান্ড বোন মিল আমদানি চক্রের যে কয়টি প্রতিষ্ঠান ঝুকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত আছে তাদের মধ্যে অন্যতম এশিয়া এন্টারপ্রাইজ। চট্টগ্রাম বন্দরে আটক হয়ে যাওয়া এসব চালান খালাস নিয়ে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানটি—এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এশিয়া এন্টারপ্রাইজ যে আটটি কনসাইনমেন্ট খালাসের দায়িত্বে আছে সেগুলোর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্পেক্ট্রা হেক্সা ফিডস লিম ফিশটেক বিডি লিমিটেড, ম্যাগনিফাই এগ্রো লিমিটেড এবং মিশাম এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এর মধ্যে ফিশটেক বিডি ও ম্যাগনিফাই এগ্রোর তিনটি করে চালান রয়েছে।

এশিয়া এন্টারপ্রাইজে কর্মরত এক কাস্টম সরকারের কাছে তাদের প্রতিষ্ঠান এবং আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হলে নানা বাহানায় তথ্য প্রদান করতে অপারগতা প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী সেলিম উদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে দাবি করে বলেন তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকই বিস্তারিত বলতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকের নাম পরিচয় জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ফিশ অ্যান্ড বোন মিল আমদানি চক্রের সাথে তার প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততার অভিযোগ সম্পর্কে সেলিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমদানিকারক বিল অব এন্ট্রিতে যে পণ্য ঘোষণা দেন তার বাইরে কী পণ্য নিয়ে আসে তা আমাদের জানার কথা নয়।’

যে চালানগুলো আটক করা হয়েছে তার বেশিরভাগ সিএন্ডএফ এজেন্ট এশিয়া এন্টারপ্রাইজ। জালিয়াতির এই ঘটনায় তার প্রতিষ্ঠান কিভাবে দায় এড়াবে এই প্রশ্নের কোন জবাব দেননি সেলিম উদ্দিন চৌধুরী।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, তিনটি পরীক্ষায় আটক হওয়া ১৮টি চালানে মিট অ্যান্ড বোন মিলের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাহলে কি এসব প্রতিষ্ঠানের রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন ভুল? শেষ পর্যন্তও যদি চালানগুলোতে মিট অ্যান্ড বোন মিলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় কাস্টমস আইন অনুযায়ী ওই পণ্য ধ্বংস করা হবে।

এসসি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!