শুকরবর্জ্যের চালান খালাসে কাস্টমসের ‘না’, আমদানিকারক তবু মরিয়া

ফিশ ফিড (মাছের খাবার) আমদানির নামে শুকরের হাড় ও বর্জ্যযুক্ত প্রাণী খাদ্য (মিট অ্যান্ড বোন মিল) নিয়ে আসার ঘটনায় আমদানিকারক প্রমেক এগ্রোর চালান খালাস না দিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। অন্যদিকে চালানটির আমদানিকারক পণ্য খালাস না দেওয়ায় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলমকে লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছেন।

একদিকে পণ্য খালাস না দিতে কাস্টম হাউজের অনড় অবস্থান, অন্যদিকে প্রমেক এগ্রোর মরিয়া অবস্থানে পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ সূত্র জানায়, ইন্দোনেশিয়া থেকে ফিশ ফিড ষোঘণা দিয়ে আমদানিকৃত চালানটিতে একাধিক রাসায়নিক পরীক্ষায় বোভাইন অ্যান্ড প্রোসিনের (শুকরজাত দ্রব্য) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমদানিনিষিদ্ধ এই পণ্য কোনভাবেই খালাসের অনুমতি দেবে না কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

প্রমেক এগ্রোর দাবি, কাস্টম কমিশনার স্থানীয় আইটিসি (ইমপোর্ট ট্রেড কন্ট্রোল) কমিটির সিদ্ধান্ত এবং আদালতের নির্দেশনা অমান্য করে পণ্য চালানটি খালাস দিচ্ছেন না। অন্যদিকে কাস্টম কমিশনারের দাবি, স্থানীয় আইটিসি কমিটির সিদ্ধান্ত একতরফা এবং প্রমেক এগ্রোর রিট পিটিশনের আদেশের বিষয়ে আপিল করা হয়েছে।

কাস্টমস সূত্র জানায়, ঢাকার মগবাজারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রমেক এগ্রো এন্ড ফিড প্রোডাক্টস লিমিটেড ফিশ ফিড আমদানির ঘোষণা দিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০ ফুট সাইজের ২৫টি কন্টেইনারে পণ্য নিয়ে আসে। এই পণ্য খালাস নিতে চট্টগ্রামের সিএন্ডএফ এজেন্ট বাংলা লাইনার এজেন্সিজ গত ১১ জুন বিল অব এন্ট্রি (সি-৯৪৩৫৭৬) দাখিল করে।

চালানটিতে ঘোষণাবহির্ভূত পণ্য থাকার খবর পেয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ খালাস স্থগিত করে এছাক ডিপোতে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করে। পরবর্তীতে ওই চালানের নমুনা কাস্টমস ল্যাবে পরীক্ষা করা হয়। গত ২৭ জুন কাস্টমসের রাসায়নিক ল্যাব ওই চালানে মিট এন্ড এন্ড বোন মিল (শুকরের হাড় ও বর্জ্যযুক্ত প্রাণী খাদ্য) পণ্য রয়েছে বলে প্রতিবেদন দেয়।

একই পণ্যের নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য ঢাকার আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আইসিডিডিআরবি) প্রেরণ করা হলে গত ১ জুলাই তাদের প্রতিবেদনে শুকরের হাড় ও বর্জ্যযুক্ত প্রাণী খাদ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়।

চালানটির আরো অধিকতর রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে নমুনা উত্তোলন করে চট্টগ্রামে পোল্ট্রি রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। গত ১৮ জুলাই ওই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনেও মিট এন্ড বোন মিলের অস্তিত্ব পাওয়া যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রমেক এগ্রোর পক্ষ থেকে পণ্য খালাস নিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনারকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে দাবি করা হয় ঘোষণা অনুযায়ী পণ্য আনার পরও পর পর ৫ বার রাসায়নিক পরীক্ষা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ বলছে, প্রমেকের দায়ের করা রিট মামলার আদেশে বলা হয়েছে স্থানীয় আইটিসি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পণ্য খালাসে করণীয় নির্ধারণ করতে। এর প্রেক্ষিতে আইটিসি কমিটিতে পণ্য খালাসের বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে সেটিকে একতরফা বলছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রমেক এগ্রোর দায়ের করা রিট মামলার আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ।

এদিকে চট্টগ্রামের আমদানি রপ্তানি নিয়ন্ত্রক ও স্থানীয় আইটিসি কমিটির সভাপতি অনুপ কুমার সাহার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। গত ৮ আগস্ট কমিটির অন্য সদস্যদের উপেক্ষা করে তিনি একাই ‘পণ্য চালানটি খালাসযোগ্য’ মর্মে সিদ্ধান্ত দেন। ওই কমিটির সভায় চট্টগ্রাম চেম্বারের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক একেএম আখতার হোসেন এবং শুল্ক বিভাগের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার কামনাশীষ। ওই সভায় তিন সদস্য উপস্থিত থাকলেও চেম্বার এবং শুল্ক বিভাগের দুই প্রতিনিধি কেউই স্বাক্ষর করেনি।

এ বিষয়ে আইটিসি কমিটির সদস্য চেম্বার প্রতিনিধি একেএম আখতার হোসেন বলেন, দুই পক্ষের কেউই একমত হচ্ছে না দেখে আমি স্বাক্ষর করিনি। তাছাড়া সভা চলাকালীন আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাওয়ায় আমি সভা শেষ না করে চলে যাই।

তিন সদস্যের কমিটির মধ্যে দুই জনের মতামত কিংবা স্বাক্ষর ছাড়া একতরফা সিদ্ধান্ত প্রদানের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় আইটিসি কমিটির সভাপতি অনুপ কুমার সাহা বলেন, ‘কমিটির দুজন প্রতিনিধির স্বাক্ষর না করলেও আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় আমাকে প্রতিবেদন দিতে হয়েছে।’

এদিকে ফিশ ফিড ঘোষণা দিয়ে মিট এন্ড বোন মিল (শুকরের হাড় ও বর্জ্যযুক্ত প্রাণী খাদ্য) নিয়ে আসার অভিযোগে বন্দরে আটককৃত ওই চালান নিয়ে আইটিসি কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, ‘ওই প্রতিবেদন একতরফা।’ উল্টো প্রশ্ন করে কাস্টম কমিশনার বলেন, ‘তাহলে একাধিক পরীক্ষায় ওই চালানে মিট এন্ড বোন মিলের অস্তিত্ব পাওয়া যাওয়ার প্রতিবেদন কি ভুল?’

প্রমেকের রিট মামলার নির্দেশনার বিরুদ্ধে যেখানে আপিল করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, সেখানে আদালতের রায় উপেক্ষা করে খালাস বন্ধ করার অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে তিনি দাবি করেন।

কাস্টম কমিশনার বলেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য আমদানির মাধ্যমে দি ইম্পোটার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স কন্ট্রোল এক্ট ১৯৫০ এবং আমদানি নীতি আদেশ ২০১৫-১৮ এর অনুচ্ছেদ ১৭, পরিশিষ্ট ১ এর খ অংশের বিধান লংঘন করেছে আমদানিকারক। কাস্টম কর্তৃপক্ষ সরকারি সেই পলিসি বাস্তবায়ন করছে।

প্রমেক এগ্রোর চিফ কমার্শিয়াল অফিসার ইলিয়াছ হোসেন রাজুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা কাস্টম কমিশনারের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিচ্ছি। গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রমেক এগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমানের পক্ষে কাস্টম কমিশনারের কাছে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।’

বিভিন্ন রাসায়নিক পরীক্ষায় ওই চালানে মিট এন্ড বোন মিলের অস্তিত্ব পাওয়া প্রসঙ্গে ইলিয়াছ হোসেন রাজু দাবি করেন, কাস্টমসের নিজস্ব ল্যাব এবং আইসিডিডিআরবির প্রতিবেদন ভুয়া।

এসসি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!