তদন্তের গতি নেই আসলের, ভুয়া অভিযোগের কদর বেশি রেলে!

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে চলছে বেনামী অভিযোগের কারবার। কখনো শ্রমিক সংগঠনের জাল প্যাডে, কখনো ভুয়া ব্যক্তির নামে পাঠানো হচ্ছে অভিযোগ। রেল ভবনের কিছু কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তার কাছে এসব অভিযোগের কদরও বেশী। বেনামে কিংবা ভুয়া অভিযোগের ফাঁদে পড়ে নাকাল রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কারণ বেনামি অভিযোগের তদন্তের চিঠি চলে আসে দ্রুত গতিতে। সে তদন্ত ঠিক মত চলে কিনা তার মনিটরিংও চলে দ্রুত।

অথচ প্রকৃত ভুক্তভোগীদের অভিযোগের নিষ্পত্তি হয় না রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতরে। এমনকি রেলমন্ত্রী কিংবা ডিজির দেওয়া তদন্তের আদেশও পড়ে থাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তির টেবিলে। তদন্তের আদেশ কার্যকর হচ্ছে কিনা সে বিষয়েও নেই কোন মনিটরিং।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা ওমর ফারুক। তিন মাসে আগে এই দায়িত্ব নেন তিনি। এসেই শ্রমিক সংগঠনের নেতা হয়ে যারা কাজ না করে বেতন তুলেন তাদের বিরুদ্ধে নিলেন ব্যবস্থা। এই কর্মকর্তার চাপে পরে তাদের যোগদান করতে হল কাজে।

এরপর থেকেই শ্রমিক নেতাদের চক্ষুশূলে পরিণত হলেন ওমর ফারুক। দিদার হোসেন নামে এক কর্মচারীর নাম দিয়ে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয় অভিযোগ। দুনীতি, স্বজনপ্রীতি, সেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি সরকার বিরোধী কমকান্ডে লিপ্ত থাকারও অভিযোগ তোলা হয় ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে।

কিন্তু যে দিদার হোসেনের নামে এ অভিযোগ পাঠানো হয়েছে রেল মন্ত্রনালয়ে সে দিদার হোসেনই জানেনা অভিযোগের কিছুই। অথচ এই অভিযোগ তদন্ত শুরু করে দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। পরে দিদার হোসেন এ বিষয়টি লিখিতভাবে জানান ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। মূলত দিদারের স্বাক্ষর জালিয়াতি করে একটি চক্র ওমর ফারুকের নামে ভুয়া অভিযোগটি পাঠায় রেল মন্ত্রনালয়ে।

এ বিষয়ে দিদার হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে গত ১ মার্চ রেলওয়ের ষ্টেশন মাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়নের প্যাডে আমার স্বাক্ষর জাল করে অভিযোগ দেওয়া হয়। এ অভিযোগ তদন্তে এলে আমি তদন্ত কমিটিকে জানাই আমি অভিযোগ করিনি। একটি চক্র তাদের স্বার্থ হাসিল করতে এই কাজ করেছে।’

রেলওয়ের ষ্টেশন মাস্টার ও কর্মচারী ইউনিয়ন চট্টগ্রামের সাধারন সম্পাদক নেজাম উদ্দিন বলেন, ‘ ‘আমাদের সংগঠনের প্যাড ব্যবহার করে যেহেতু অভিযোগটি হয়েছে সেহেতু আমাদের কাছ থেকে মন্ত্রণালয় জিজ্ঞেস করলে ভাল হতো। এতে অভিযোগটি আসল নাকি নকল তা যাচাই হতো। এমন ভুয়া অভিযোগে কাউকে হয়রানি করা দুঃখজনক।’

এছাড়া পরিবহন কর্মকর্তা ওমর ফারুকের বিরুদ্ধে জানে আলম নামে এক ব্যক্তির নামে একটি অভিযোগ যায় মন্ত্রনালয়ে। তার পদবী লিখা হয় অস্থায়ী গেট কিপার। কিন্তু রেলওয়ের অস্থায়ী গেট কিপার পদে কর্মরতদের মধ্যে জানে আলম নামে কোন ব্যক্তির হদিস মিলেনি। অভিযোগটিতে উল্লিখিত মোবাইল নম্বরেও পাওয়া যায়নি কাউকে।

এসব বিষয়ে পরিবহন কর্মকর্তা ওমর ফারুক (ডিটিও) বলেন, ‘তিন মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে ২৫ বছর ধরে বন্ধ থাকা ষ্টেশন চালু করেছি। শ্রমিক স্বল্পতার কারণে কার্যক্রম পরিচালনা কষ্ট হচ্ছিল বিধায় অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে কাজের গতি বৃদ্ধি করলাম। শ্রমিক নেতার সাইনবোর্ড দেখিয়ে কাজ না করে বেতন তোলা বন্ধ করলাম। এসব কারণে কেউ কেউ বেনামে অভিযোগ দিচ্ছে আমার বিরুদ্ধে। এখন আমি কি ভুয়া অভিযোগের পিছনে সময় ব্যয় করবো নাকি রেলওয়েকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করবো।’

রেলওয়ে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় দফতরের একটি সিন্ডিকেট কর্মকর্তাদের চাপে রাখতে এসব ভুয়া অভিযোগ পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। সঙ্গে পাঠানো হয় নির্দিষ্ট অংকের অর্থ। এ কারণে রেল মন্ত্রনালয়ের একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তারা এই ধরণের ভুয়া অভিযোগগুলো এলেই তদন্তে তোড়জোড় শুরু করে দেয়।

অথচ সঠিক কোন বিষয়ে অভিযোগ করা হলে তা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ থাকেনা সেই কর্মকর্তাদের। এমনকি কোন অভিযোগ তদন্তে রেলমন্ত্রীর নির্দেশনা থাকলে সেটাও আটকে থাকে লাল ফিতায় বন্দি হয়ে।

সংগঠনের প্যাডে ভুয়া অভিযোগ কদর পেলেও মন্ত্রীর সুপারিশসহ অভিযোগপত্রের কোন খবর থাকে না
সংগঠনের প্যাডে ভুয়া অভিযোগ কদর পেলেও মন্ত্রীর সুপারিশসহ অভিযোগপত্রের কোন খবর থাকে না

জানা গেছে, হালিশহর রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমির উচ্চমান সহকারী মেহেরুন আক্তার জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও তার মিলেছে পদোন্নতি। একই পদের মাহমুদা খানম তার ৮ বছরের সিনিয়র হলেও তাকে ডিঙিয়ে মেহেরুনকে পদোন্নতি দেওয়ার অভিযোগ উঠে। বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে মাহমুদা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করে। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হয় রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় দফতরে। কিন্তু এ অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, বেআইনিভাবে ৮ বছরের জুনিয়র মেহেরুনের পদোন্নতিকে বৈধ সাব্যস্ত করতে উপেক্ষা করা হয় রেলমন্ত্রীর তদন্তের আদেশ। শুধু তাই নয়, উল্টো প্রতিকার চাওয়া উচ্চমান সহকারী মাহমুদাকে বরখাস্তের আদেশ দেওয়া হয় কথিত অসদাচরণের অভিযোগ তুলে।

এদিকে গত ২০ এপ্রিল সকালে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলীয় ট্রেনিং একাডেমি (আরটিএ) প্রধানের (রেক্টর) গাড়ি ব্যবহার করে ধরা পড়েন ওই একাডেমির উচ্চমান সহকারী মেহরুন আক্তার। হালিশহর রেলওয়ে আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়েই রেক্টরের গাড়ি নিয়ে আরটিএ’তে প্রবেশের সময় নিরাপত্তারক্ষীরা গাড়িটি থামায়। নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে রেক্টরের গাড়ি থেকে নেমে বাকবিতন্ডায় জড়ান মেহেরুন। এ সময় রেলওয়ে আবাসিক এলাকার লোকজন জড়ো হলে রেক্টরের গাড়ি গেটে রেখেই সটকে পড়েন মেহেরুন ও গাড়ির চালক।

কর্মচারী হয়ে বিনা অনুমতিতে অফিস প্রধানের গাড়ি ব্যবহারের নজিরবিহীন ঘটনায়ও এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে আরটিএ রেক্টর সর্দার শাহাদাৎ আলী বলেন, ‘করোনার কারনে অফিস বন্ধ রয়েছে। অফিস খুললে আমার জন্য নির্ধারিত গাড়ি বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করার বিষয়টি নিয়ে ব্যবস্থা নিব।’

এছাড়া গত ১৩ এপ্রিল ইলিশ মাছ আনতে বিশেষ ট্রেনকে চাঁদপুর পাঠানোর ঘটনায় লিখিত কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছে বিভাগীয় কর্নকর্তা (ডিআরএম) সাদেকুর রহমানের কাছে। তবে গণমাধ্যমে সাদেকুর রহমান ও গার্ড মহিউদ্দিনের নাম আসায় এমন কৈফিয়ত। প্রকৃত ঘটনার মূল নায়ক বিভাগীয় প্রকৌশলী (১) হামিদুর রহমান। চাঁদপুর থেকে মাছ প্রেরণ করেন প্রকৌশলী সোলেমানের অধীনস্থ খালাসী। উভয়ে মাছের আদান প্রদানের কথা স্বীকার করেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে।

রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, ‘ভুয়া অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে কমিটি হয়ে যাচ্ছে। তদন্তের নামে হয়রানি করা হচ্ছে৷ অথচ পদোন্নতি সংক্রান্ত কিংবা যেকোন বিষয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অন্যায়ের শিকার হয়ে অভিযোগ করলে তা পড়ে থাকে। ঢাকার রেল ভবনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তাদের ভুয়া অভিযোগের কদর বেশি। টাকার বিনিময়ে তারা এসব তদন্তের নামে মানসিকভাবে সৎ কর্মকর্তাদের চাপে রাখে। বিনিময়ে সিন্ডিকেটের লোকজন ফায়দা নেয়।’

ভুয়া অভিযোগের তদন্ত হওয়া ও সঠিক অভিযোগের তদন্ত না হওয়ার বিষয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক (ডিজি) মো. শামসুজ্জামান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অভিযোগ এলে আমরা খতিয়ে দেখি। সেক্ষেত্রে ভুয়া অভিযোগের কারণে যেন কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে আমরা সর্তক দৃষ্টি রাখি আমরা।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!