চট্টগ্রামে যে কারণে এইচএসসির ৩ বিষয়ে নম্বর কম এলো

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি ও অর্থনীতি প্রশ্নপত্রে গোলক ধাঁধায় পড়েছিল শিক্ষার্থীরা। এমসিকিউতে বাংলায় কনফিউজিং প্রশ্ন, ইংরেজিতে প্যারাগ্রাফ ও কম্পোজিশনসহ প্রশ্ন সম্পূর্ণ নতুন ভাব এবং অর্থনীতির জটিল প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের পাসের হারের সঙ্গে জিপিএ-৫ এ প্রভাব ফেলেছে।

তবে শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা মূল পাঠ্য বই পড়া থেকে সরে এসে কোচিংমুখি হওয়ায় প্রশ্নপত্রের ভিন্নতা শিক্ষার্থীরা গুলিয়ে ফেলেছে। আবার একইসঙ্গে সৃজনশীল ট্রেনিং বর্তমানে কম হওয়ায় শিক্ষকরাও প্রশ্নপত্রে সৃজনশীলতার ধাঁচ আনতে পারেননি। এমসিকিউতে প্রশ্নগুলো সবগুলোর উত্তর কাছাকাছি থাকায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে এবার ১ লাখ ১ হাজার ৯৪৯ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাস করেছে ৭৫ হাজার ৯০৩ জন। পাসের হার ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। আর ফেল করেছে ২৬ হাজার ৪৬ জন।

গত বছর ৯১ হাজার ৯৬০ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। পাস পাসের হার ছিল ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ। আর এবছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ৬ হাজার ৩৩৯ জন। গতবছর এ সংখ্যা ছিল ১২ হাজার ৬৭০ জন।

পরীক্ষার্থী ও শিক্ষকরা বলছেন, মূলত বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যে খারপ করাতে সার্বিক ফলোফলে প্রভাব পড়েছে।

বাংলা ১ম পত্রে ৯২ হাজার ৫২২ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পাস করেছে ৮৫ হাজার ৯১৫ জন। হিসেবে ফেল করেছে ৬ হাজার ৬০৭ জন।

ইংরেজি ১ম পত্রে ৯৭ হাজার ৯১৫ জন অংশ নিয়ে পাস করেছে ৯০ হাজার ১৩১ জন। ফেল করেছে ৭ হাজার ৭৮৪ জন।

অর্থনীতি ১ম পত্রে ৫৫ হাজার ১০৮ জন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে পাস করেছে ৪৭ হাজার ১৪৯ জন। ফেল করেছে ৭ হাজার ৯৫৯ জন।

মহসিন কলেজ থেকে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ইয়াদ জানান, বাংলা ১ম পত্রে এমসিকিউ পশ্ন কনফিউজিং ছিল। মনে হচ্ছিল একই প্রশ্নের উত্তরগুলোর মধ্যে সবগুলোই সঠিক বলে মনে হচ্ছিল। ডিসিশন নিতে পারছিলাম না কোনটাতে টিক দেবো? আর এ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে অনেক সময় পার হয়ে যায়। আর এজন্য সবগুলো উত্তর শেষ করতে বেগ পেতে হয়েছে।বাংলাতে তার নম্বর এ প্লাস আসেনি।

ইয়াদ আরও বলেন, ইংরেজি ২য় পত্রে কম্পোজিশন ও প্যারাগ্রাফে প্রবলেম ফেস করতে হয়েছে। কম্পোজিশন যেটি এসেছে, সেটি আমরা সচরাচর দেখিনি। আর যেরকম প্যারাগ্রাফ এসেছিলো, সেরকম প্যারাগ্রাফ আমরা প্র্যাকটিসও করিনি। কম্পোজিশন ও প্যারাগ্রাফ কমন পড়েনি। আর এখানেই অনেকের নম্বর ছুটে গেছে। জিপিএ-৫ হাতছাড়া হয়েছে।

আর মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের অর্থনীতি বিষয়ে খারাপ হয়েছে। পটিয়া খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ থেকে অংশ নেওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী রিমি জানায়, তার অর্থনীতিতে খারাপ হয়েছিল। অর্থনীতি প্রথম পত্রের বেশিরভাগ ছিল ম্যাথমেটিক্যাল টার্ম। আর এটা অনেক অন্যরকম মনে হয়েছিল। পরীক্ষায় বেশিরভাগ প্রশ্নই আনকমন ছিল। সময়ের সঙ্গে উত্তর কুলাতে পারেনি।

তবে প্রশ্নপত্র জটিলতা ও আনকমন ছিল না বলে জানান অধিকাংশ শিক্ষক। শিক্ষকদের অভিমত, ছেলেমেয়েরা মূল পাঠ্যবই পড়ে না। যার কারণে বিষয় সম্পর্কে সে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হতে পারে না। মূল বই যে ছেলেমেয়ে পড়বে, সে কখনও খারাপ করতে পারে না। সেটি এমসিকিউ অথবা সৃজনশীল হোক। আর সহযোগী বইয়ের টার্গেট শুধু শিক্ষার্থীদের না। শিক্ষকদেরও সহযোগী বইয়ের সাহায্য নিতে হবে। আর শিক্ষার্থীরা কম লেখার অভ্যাসও খারাপ ফলাফলে প্রভাব পড়েছে।

শিক্ষকরা আরও বলেন, এই যুগে ছেলেমেয়েরা লেখে কম। ধরুন, একটি রুটিন টাঙানো হলে তারা মোবাইল দিয়ে ছবি তোলে, কেউ লেখে না। নোট ও মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে আসে। কম্পিউটার স্ক্রিনে পড়াশোনা করে। আর পরীক্ষায় সাতটা সৃজনশীল প্রশ্নের প্রতিটির উত্তর নির্ধারিত থাকে ২০ মিনিট করে। লেখার কম প্র্যাকটিসের জন্য তারা এ সময় কুলাতে পারে না।

চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডর সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাংলা ও ইংরেজি মূলত পরীক্ষার শুরুতেই হয়ে থাকে। এভাবেই পরীক্ষার্থীরা প্রস্তুত নিয়ে থাকে। কিন্তু দেশের বন্য ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য বাংলা ও ইংরেজি পরীক্ষা সবার পেছনে অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিক্ষার্থীদের যেরকম প্রস্তুতি ছিল, শেষে এসে তা ভাটা পড়ে। আর বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার জন্য বাংলা ও ইংরেজিকে কম গুরুত্ব দিয়ে ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, বায়োলজিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এর প্রভাব এইচএসসির বাংলা ও ইংরেজিতে পড়ে।’

তবে বাংলাতে খারাপ হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন চট্টগ্রাম কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুস সালাম। তিনি বলেন, বাংলা ১ম পত্রের প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের কাছে কনফিউজিং মনে হওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। কারণ প্রশ্নের সবগুলো উত্তরই কাছাকাছি ছিল। আসলে যারা প্রশ্নপত্র তৈরি করছেন, তাদের সৃজনশীল ট্রেনিং নেই বললেই চলে। প্রথম ধাপে যারা সৃজনশীল ট্রেনিং করেছেন, তাদের অনেকেই একাডেমিক সেশন ছেড়ে প্রশাসনে চলে গেছেন। প্রশ্ন তৈরির নিয়মকানুন বর্তমান শিক্ষকদের নেই বললেই চলে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলায় খারাপ করার সবচেয়ে বড় কারণ—শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতা। আমরা ক্লাশে গিয়ে শিক্ষার্থী পাই না। নিয়মিত ক্লাস করে না। একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে যা শিখবে, তা কোচিংয়ে শিখবে না। আর কোচিংয়ে একসঙ্গে সব বিষয় পড়ানো হয়। তাই শিক্ষার্থীদের ক্লাসমুখি হতে হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!