চট্টগ্রামে বিএনপি নেতাকে পিটিয়ে খুন, জুমা পড়ে বের হতেই একযোগে হামলা

নেতার অনুমতি নিয়ে রাউজানে ঢুকেছিলেন মা-বাবার কবর জেয়ারতে

চট্টগ্রামের রাউজানে জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের প্রচণ্ড মারধরে প্রবাসফেরত এক বিএনপি নেতার মৃত্যু হয়েছে। নিহত নেতার স্বজনরা ‘পিটিয়ে হত্যা’র অভিযোগ করলেও স্থানীয় থানার পুলিশ বলছে, ‘হাতাহাতির মধ্যে উত্তেজিত হয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে’ ওই বিএনপি নেতা মারা গেছেন।

শুক্রবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) জুমার নামাজের পর রাউজান পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ঢেউয়া হাজীপাড়া জামে মসজিদের সামনে এই ঘটনা ঘটেছে। ৪৫ বছর বয়সী ওই বিএনপি নেতার নাম মোহাম্মদ মুছা। তিনি ওমানের ওয়াইলজা শাখা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ঢেউয়া হাজীপাড়া গ্রামের বাচন আলী হাজির বাড়ির কবির আহম্মদের ছেলে তিনি।

মুছা রাউজান বিএনপির রাজনীতিতে গিয়াস কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে সক্রিয় ছিলেন। চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় ছাড়ার পর তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে চলে যান। সেখানে তিনি বিএনপির স্থানীয় একটি শাখার সহ সভাপতি ছিলেন। মুছা পরে আরব আমিরাতের দুবাইয়ে যান। সেখানেও তিনি বিএনপির একটি শাখার যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। সর্বশেষ তিনি ওমানে বসবাস শুরু করেন। গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর মুছা ওমান থেকে বাংলাদেশে আসেন। ৫ মার্চ তার ওমানে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল।

দুই সন্তানের জনক মুছার বড় ছেলে মারজান হোসেন সানি (১০) পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছোট ছেলে তানভীর হোসেন সাঈদ (৪) শিশু শ্রেণিতে পড়ছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নন্দীর হাট এলাকায় তারা মায়ের সঙ্গে থাকে।

জানা গেছে, প্রবাস থেকে বিভিন্ন সময় দেশে এলেও প্রাণভয়ে মুছা কখনও এলাকায় যাননি। দুই মাস আগে দেশে ফেরার পর তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ইকবালের সঙ্গে দেখা করে তার কাছ থেকে এলাকায় যাওয়ার ব্যাপারে ‘সম্মতি’ নেন। মা-বাবার কবর জেয়ারত করার উদ্দেশ্যে ১৭ বছর পর বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) রাউজানে নিজের বাড়িতে যান মুছা।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বাড়ির মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে যান মুছা। নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় ‘সম্মতি দেওয়া’ সেই আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বেই ২৫ থেকে ৩০ জন লোক তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ সময় তাকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। এর একপর্যায়ে মুছা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। পরবর্তীতে ঘটনাস্থলে থাকা তার দুই ভাই মুছাকে উদ্ধার করে রাউজান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তবে আগেই মৃত্যু হওয়ায় ডাক্তারও তাকে তাৎক্ষণিক মৃত ঘোষণা করেন।

মুছাকে হত্যা করা হয়েছে— এমন অভিযোগ এনে তার ভাই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. ইউছুফ বলেন, ‘মুছা ওমানপ্রবাসী। তিনি ১৭ ডিসেম্বর দেশে আসেন। তিনি হাটহাজারী শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকতেন। শুক্রবার নামাজের আগে হাজীপাড়ায় আসেন জুমার নামাজ আদায় ও মা-বাবার কবর জিয়ারতের জন্য। নামাজ আদায় করার পর মসজিদের সামনে রাস্তায় তাকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত কিলঘুষি মারে। এরপর আমি মসজিদের ভেতর থেকে দৌড়ে এসে ভাইকে বাঁচাতে এগিয়ে আসি। একপর্যায়ে মুছা লুটিয়ে পড়লে আমি ও আমার জেঠাতো ভাই রাউজান হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

নিহত মুছার অপর ভাই তৌফিকুল বলেন, ‘আমার ভাই গিয়াস কাদেরের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। বিএনপি সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পরই তিনি ওমানে চলে যান।এর মধ্যে কয়েকবার দেশে আসলেও এলাকায় আসেননি। হাটহাজারীর শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। বৃহস্পতিবার আমি আমার ভাইকে নিয়ে এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ইকবালের সঙ্গে তার শহরের অফিসে দেখা করি। তাকে আমার ভাই বলেছিলেন, তিনি আজকে বাবার কবর জিয়ারত করতে এলাকায় যাবেন। তাকে যেন তিনি প্রটেকশন দেন। তিনি আমার ভাইকে কথাও দিয়েছিলেন। আর এখন শুনলাম উনার নেতৃত্বে শুক্রবার জুমার নামাজের পরই আমার ভাইকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।’

যার বিরুদ্ধে ‘পিটিয়ে হত্যা’র অভিযোগ, সেই আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ইকবাল অবশ্য বলছেন, ‘ওরা আমার শহরের অফিসে এসেছিল—এই দাবি সত্য না। তাছাড়া মুছাকে পিটিয়ে মারা হয়েছে এটাও সত্য না।’

তাহলে হঠাৎ মুছার মৃত্যু হল কিভাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে শাহজালাল ইকবাল বলেন, ‘সেটা আমি বলতে পারি না। ওই সময় আমি মসজিদ কমিটির মিটিংয়ে ছিলাম।’

‘মিটিং’ শেষে মসজিদ থেকে বের হয়ে মুছার মৃত্যুর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগ নেতা শাহজাহান ইকবাল বলেন, ‘আমি তো এগুলোর সাথে জড়িত না। আমি তো জানি না।’

এদিকে রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি ) জাহেদ হোসেন বললেন, ‘মুছা নামের বিএনপির এই কর্মী মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল আজকে। সেখানে স্থানীয় কয়েকজনের সাথে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে তিনি উত্তেজিত হয়ে জ্ঞান হারান। খবর শুনে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। লাশের গায়ে কোন আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ডাক্তার এটাকে কার্ডিয়াক এরেস্টে মৃত্যু বলে সার্টিফাই করেছে।’

তিনি বলেন, ‘তবু আমরা ময়নাতদন্তের জন্য লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথবা পরিবার যদি কোন অভিযোগ করে সে অভিযোগের ভিত্তিতেও আমরা ব্যবস্থা নেবো। তবে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ আমরা পাইনি।’

১৫ বছর ধরে নিজের জন্মস্থান রাউজানে যেতে পারেন না— এমন এক বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ধরেন আমার মাও যদি মারা যায়, আমি তার জানাজায় শরিক হতে ওখানে যেতে পারবো না। গেলে আমাদের মেরে ফেলবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!