ওয়াসার ‘প্রেসার মাপা’ হাসপাতালে ৫ স্টাফের বেতনই বছরে ৩৬ লাখ!

বছরে গচ্চা লাখ লাখ টাকা, বরাদ্দ হলেও সরঞ্জাম-ওষুধ কেনা হয় না

এমনই এক হাসপাতাল— নিতান্ত দায়ে না পড়লে কেউ ওমুখো হতে চায় না। ডাক্তার-নার্সরাও থাকেন প্রায়ই ছুটিতে। কেউ কেউ ব্লাড প্রেসার মাপাতে গেলে অভিযোগ শোনা যায়, তার ফলাফলও আসে ভুল। প্যারাসিটামল-ভিটামিন ওষুধ দেওয়া ছাড়া বলতে গেলে কোনো সেবা পান না কেউ। তবে এমন আজব হাসপাতালের পেছনে লাখ লাখ টাকা ঠিকই গচ্চা যাচ্ছে প্রতি বছর। হাসপাতালে ‘কর্মরত’ পাঁচজনের বেতন খাতেই বছরে যাচ্ছে ৩৬ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য ১৫ লাখ টাকা পেয়েও সেই টাকায় প্রায় কিছুই কেনা হয়নি।

ওয়াসার ‘প্রেসার মাপা’ হাসপাতালে ৫ স্টাফের বেতনই বছরে ৩৬ লাখ! 1

এমন উদ্ভট হাসপাতালটি আছে চট্টগ্রাম ওয়াসায়। সেখানকার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য হাসপাতালটি স্থাপন করা হলেও সেখানে মেলে না কোনো চিকিৎসাসেবা। পুরাতন-নোংরা বেড ও চেয়ার-টেবিল দিয়েই চলছে এ হাসপাতাল। ন্যূনতম প্রাথমিক সেবাও না পাওয়ায় ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সেদিকে যান না। প্রতি বছর ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম কিনতে লাখ লাখ টাকা দেওয়া হলেও কেন কিছুই কেনা হয় না— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করেছেন, বরাদ্দের টাকায় এ পর্যন্ত কিছু ওষুধ কেনা হয়েছে। বাকি অর্থ পরের মাসগুলোতে ‘অ্যাডজাস্ট’ করা হবে।

এক রুমেই অফিস ও রোগীর বেড

চট্টগ্রাম ওয়াসা ভবনের চতুর্থ তলায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থাকলেও সেটি চলছে ‘নামকাওয়াস্তে’। এখানে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন সহকারী ফার্মাসিউটক্যালস, একজন মেডিকেল এটেনডেন্ট, একজন নার্স ও একজন হেলপার কাম ক্লিনার আছেন।

সরেজমিনে দেখা গেছে, হাসপাতালের জন্য নির্ধারিত দুই রুমের মধ্যে একটি চিকিৎসা কর্মকর্তার জন্য নির্ধারিত। উনি ছুটিতে থাকলে রুমটি থাকে তালাবদ্ধ। অন্য রুমে অপর চারজন চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসেন। তাদের ওই রুমেই রয়েছে একটি ছোট বেড। যেটির ওপর নোংরা বালিশ ও রেক্সিন দিয়ে রাখা হয়েছে। একজন রোগীকে প্রাথমিক সেবা দেওয়ার যেসব উপকরণ তা চোখে পড়েনি কোথাও। অথচ হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে রোগীর জন্য আলাদা রুম থাকার কথা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির একাধিক কর্মচারী জানান, তারা মাঝেমধ্যে প্রেসার মাপাতে যান হাসপাতালে। কিন্তু সেই প্রেসারের মাপও ঠিকভাবে আসে না। প্রাথমিক চিকিৎসাও মেলে না এই হাসপাতালে। তাই কারও আগ্রহ হয় না এখানে চিকিৎসা নেওয়ার।

বছরে ‘গচ্চা’ ৩৬ লাখ

চট্টগ্রাম ওয়াসায় প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থ বরাদ্দ হয়ে থাকে হাসপাতালের মেডিকেল যন্ত্রপাতি এবং ওষুধ কেনার জন্য। কিন্তু প্রতিবার বরাদ্দ হলেও কোনো ধরনের উন্নতি হয়নি হাসপাতালের। প্রাথমিক সেবার জন্য কোনো ধরনের উন্নত যন্ত্রপাতিও নেই এখানে। চিকিৎসাসেবার মধ্যে রয়েছে শুধুমাত্র প্রেসার মাপা এবং প্যারাসিটামল, ব্যথার ওষুধ ও ভিটামিন ক্যাপসুল দেওয়া।

এখানে কর্মরত পাঁচজন হলেন—চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মো. মোছলেহ উদ্দিন, সহকারী ফার্মাসিউটিক্যালস সিহাব উদ্দিন, নার্স নূর নাহার বেগম, মেডিকেল এটেনডেন্ট রিনা আক্তার ও হেলপার কাম ক্লিনার নেজামুল ইসলাম। তাদের বেতন বাবদ প্রতি মাসে ওয়াসার খরচ হয় ৩ লাখ টাকা— বছরে যা দাঁড়ায় ৩৬ লাখ।

ওয়াসার চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মোসলেহ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তেমন কোনো যন্ত্রপাতি এই অর্থবছরে এখনও পাইনি। আসলে চিকিৎসা কেন্দ্রে শুধুমাত্র কিছু ওষুধপত্র দেওয়া হয়। ওষুধগুলোর মধ্যে প্যারাসিটামল, পেইন কিলার, কিছু স্যালাইন ও ভিটামিন ক্যাপসুল থাকে।’

একমাত্র ডাক্তার ৩৩ বছর ধরে

চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মো. মোছলেহ উদ্দিন ১৯৯১ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসায় চিকিৎসা কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। গত বছর তার চাকরি শেষ হলেও পুনরায় চুক্তিতে আবার নিয়োগ পান তিনি। চুক্তিভিত্তিক হলেও নিয়মিত কর্মকর্তার মতো সব সুবিধাই তিনি ভোগ করছেন। বর্তমানে তিনি ৬৯ হাজার ৪৫০ টাকা বেতন পান।

তবে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়ার কয়েক মাস না যেতেই তার কিডনি জটিলতা দেখা দেয়। ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপন শেষে দেশে ফিরেন চলতি মাসেই। তিনি ছুটিতে থাকবেন ফেব্রুয়ারির ১ম সপ্তাহ পর্যন্ত।

এ বিষয়ে ডা. মোছলেহ বলেন, আমি ছুটিতে থাকায় নার্স আর মেডিকেল এটেনডেন্টরা মিলে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। মূলত এটি ফাস্টএইড সেন্টার।’

প্রায় ছুটিতে থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

হাসপাতালে প্রায়ই অলস সময় পার করেন কর্মচারীরা। বেশিরভাগ সময় এখানকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থাকেন ছুটিতে। আর রোগী না থাকার সুবাদে গল্প-গুজব করেই তাদের সময় কাটে। হাসপাতালের নার্স নূর নাহার বেগম ব্ল্যাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিনিও থাকেন বেশিরভাগ সময় ছুটিতে।

সম্প্রতি সরেজমিন হাসপাতাল গিয়ে শুধুমাত্র নূর নাহার বেগম ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। ওয়াসার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কয়েকজন কর্মচারী প্রেসার মাপতে আসলে তিনি তা মেপে কাগজে লিখে দিচ্ছিলেন। প্রায় দু’ঘণ্টা থাকার পরও দেখা মেলেনি সহকারী ফারমাসিউটিক্যালস সিহাব উদ্দিনের। মেডিকেল এটেনডেন্ট রিনা আক্তারও ছিলেন ছুটিতে। এদিকে হাসপাতালের ডাক্তারও বর্তমানে ছুটিতে আছেন।

হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার বিষয়ে জানতে চাইলে ওয়াসার চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মোছলেহ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম ওয়াসার মেডিকেল শাখা আদতে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রের পর্যায়ে পড়ে না। ছোট দুটো রুম—একটা রুমে আমি বসি, বাকিটাতে অন্য স্টাফরা। যে একটা বেড পাতানো রয়েছে, সেটাতে রোগীকে শুইয়ে অবজারভেশন করা হয়। মূলত আমরা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকি। চিকিৎসা কেন্দ্রে মূলত স্টাফরা আসে প্রেসার মাপতেই।’

চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে বরাদ্দের ১৫ লাখ টাকায় আমরা কিছু ওষুধ কিনেছি। অর্থবছরের বাকি সময় এখনও পড়ে আছে। সে সময়ে পুরো অর্থ এডজাস্ট করা হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!