আবুল কালাম তালুকদারের গ্রন্থ প্রসঙ্গে কিছু কথা…

কাব্যগ্রন্থ : চিঠি দিলেম বেলা শেষে

উপন্যাস : কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি

রচয়িতা : আবুল কালাম তালুকদার

‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে
টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’

এক মাহেন্দ্রক্ষণে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দুটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয় ২০২২ সালের ২৮ জানুয়ারি। প্রধান অতিথি হিসেবে সেদিন উপস্থিত ছিলাম আমি। চমকপ্রদ বিষয় যে, সেই অনুষ্ঠানে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের আমার প্রিয় প্রাক্তন ছাত্রী, চন্দনাইশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাছরীন আক্তার। সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনায় গ্রন্থ দুটির কথামুখ লিখেছে নাছরীন নিজেই, যা আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লেখক শামসুদ্দীন শিশিরসহ অনেকে। সব মিলিয়ে অনুষ্ঠান ছিল অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও মনোমুগ্ধকর।

প্রথমে আমি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোকপাত করছি।

গ্রন্থটি পাঠ করে আমি অমিয় তৃপ্তি লাভ করি। গ্রন্থে নিবন্ধিত প্রতিটি কবিতা যেন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। জীবনের আষ্টেপৃষ্টে লেগে থাকা সুখ-দুঃখের গল্পগুলো কবির নিপুণ গাঁথুনিতে বাস্তবতায় প্রতিভাত হয়ে ধরা দিয়েছে। কবিতায় সাবলীল ছন্দের দোলা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কেবল অলংকার সমৃদ্ধ ভাষার সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে দিলে কবিতা হয় না, তার সঙ্গে যা প্রয়োজন তা হলো—ভাব ও ভাবনার মেলবন্ধন; দর্শনের সুনিপুণ বুনন। তাঁর লেখায় এই মিশ্রণের স্নিগ্ধতা আমি পেয়েছি। তাই তিনি কবি; তাঁর লেখাগুলো কবিতা।

পল্লী কবি জসিম উদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায় পল্লীর অনুপম সৌন্দর্যের যে অপূর্ব প্রকাশ ঘটেছে, এই গ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘এসো আমার গাঁয়ে’ কবিতায় যেন তারই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি অবলীলায়। তাঁর ‘ছেঁড়াচিঠি’ কবিতায় বিভিন্ন ভাগে সাধারণ নর-নারী ও তরুণ-তরুণীর স্বপ্নের যে অপমৃত্যু ঘটেছে কিছুসংখ্যক মানুষ নামের হায়েনার বিষাক্ত ছোবলে, তার বিরুদ্ধে কবি অত্যন্ত সাহসিকতার কলম বিদ্রোহ করেছেন। তার অনবদ্য প্রেমের কবিতাগুলো আমার কাছে অনিন্দ্যরূপে ধরা দিয়েছে। মিলনের সুখ-স্মৃতি এবং বিরহের বেদনাগুলো অত্যজ্জ্বল উপমায় অলংকৃত হয়েছে। তাঁর বিরহ মিলনের কবিতাগুলো পাঠ করে আমি অশ্রুসিক্ত হই। অনেকের জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মেলবন্ধন যেন আমি বাস্তবে খুঁজে পেয়েছি তাঁর কবিতায়।

সত্যিকার অর্থে এখানেই কবির সার্থকতা। ‘স্বপ্নসেতু : মোরা গর্বিত জাতি’ কবিতাগুলো গ্রন্থটিকে মহিমান্বিত করেছে এবং দেশের প্রতি কবির গভীর মমত্ববোধের বাঙময় প্রকাশ। ‘হলুদ পাখিটিরে দেখিনা আর’ কবিতাটি কবির এক অনন্য সৃষ্টি, যেখানে দর্পণের মতো ভেসে উঠেছে বর্তমান সমাজের সমসাময়িক অনেক বেদনাবহ চিত্র। এই কবিতায় রূপক শব্দের ব্যবহারগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

পরিশেষে বলতে হয়, সহজ-সরল ও সাবলীল উপস্থাপনায় জীবন-দর্শনের সুনিপুণ বুননে এবং উপমা অলংকারের নান্দনিক ভূষণে গ্রন্থটি কবির অসাধারণ সৃষ্টিশীলতার মাচনীয় স্বাক্ষর বহন করে।

তাঁর কাব্য উপন্যাস ‘কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি’ গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে বাংলা সাহিত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে এক সৎ সাহসী যুবক সেলিমের সত্য বাক্য প্রকাশ ও ধর্ষিতা তরুণী শায়লার সুবিচার প্রাপ্তি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে রচিত এই উপন্যাসটি পাঠ করে আমি মুগ্ধ। এই উপন্যাসে নজরুল-রবীন্দ্র ভাবধারার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। কবিগুরুর ‘শেষের কবিতা’য় ব্যারিস্টার অমিত রায় ও শ্রীমতি লাবণ্যলতার প্রেম-বিরহের সংলাপ এবং হৃদয়ছোঁয়া কথোপকথন যেভাবে কবিতাশ্রিত হয়েছে, এখানেও সেলিম-শায়লার বাক বিনিময় ছন্দাশ্রিত হয়েছে। ‘শেষের কবিতা’ সমাপ্তি ঘটেছে বিরহে আর ‘কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি’র যবনিকা নেমে এসেছে ধর্ষিতা নারীর প্রতি হৃদয়ের উদার ভালবাসায় মিলনের সুর মূর্ছনায়। উপন্যাসটি সামাজিক কু-প্রথা, অবিচার, অনাচার ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংস্কারের বিজয়কেতন। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে গ্রন্থটি বিশেষ অবদান রাখবে বলে আমার সুদৃঢ় প্রতীতি। অনুপম সুকুমারবৃত্তি আর মানবতার স্নিগ্ধছোঁয়ায় ঋদ্ধ কবি আর তাঁরই হৃদয়ের নির্যাস কবিতার আলোকছটায় উদ্ভাসিত হোক এই তমসাঢাকা যুদ্ধ-যন্ত্রণায় কাতর বসুধা। জয় হোক কবি ও কবিতার। কবিতা নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকে জীবনের পরতে পরতে—

জিহ্বায় উচ্চরিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা,
কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানাই কবিতা।
যে কবিতা শুনতে জানে না
সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।
যখন মানুষ মানুষকে ভালবাসবে
তখন প্রত্যেকে কবি।

সসস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা
সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা।
জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা
রক্তজবার মতো প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।

লেখক :
প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ এবং সিনেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!