ভান্ডারীকেই ‘হেফাজত আমির’ হওয়ার আহ্বান নদভীর, একহাত নিলেন ফেসবুক লাইভে এসে (ভিডিও)

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সাংসদ সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে হেফাজতে ইসলামের ‘আমির’ হওয়ার পরামর্শ দিলেন সাতকানিয়ার-লোহাগাড়ার সাংসদ অধ্যাপক ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী। এর কয়েক ঘন্টা আগে রোববার (২৫ অক্টোবর) বিকেলে ফটিকছড়ির নাজিরহাটে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নজিবুল বশর হেফাজতে ইসলামের সংগঠনটির আমির হিসেবে বর্তমান মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর নাম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এই প্রস্তাবেরই পাল্টা হিসেবে নদভীর এই ফেসবুক লাইভে আসা— এমনটি মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোববার (২৫ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১১টার পর সাংসদের ফেসবুক পেইজের লাইভে এসে নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে উদ্দেশ্য করে সাংসদ নদভী বলেন, ‘আমাদের কওমীদের সাথে যদি আপনি বেশি মহব্বত (ভালোবাসা) রাখেন, তাহলে আপনি হেফাজতের আমির হয়ে গেলে বেশি ভালো হবে। আমিরে হেফাজত, আল্লামা আহমদ শফী সাহেব মারা গেছেন। (এখন) আপনি আমিরে হেফাজত হয়ে গেলে বেশি ভালো হবে।’

২৩ মিনিট ৫০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে নদভী প্রথম সাড়ে তিন মিনিট ফ্রান্সে মহনবী হযরত মুহাম্মদের (সা.) ব্যঙ্গচিত্র প্রদশর্নের নিন্দা জানিয়ে কথা বলেন। তারপর প্রায় ছয় মিনিট নিজের পরিবারের কথা উল্লেখ করে নদভী বলেন, ‘আমার দাদার দরগাহ করলে সেটা হতো বাংলাদেশের এক নম্বর দরগাহ। কিন্তু বেদাত শিরক এগুলো করি না। বেদাত শিরক থেকে আমরা মুক্ত। আমরা কুরআন এবং সুন্নাহর ওপর আমল করার চেষ্টা করি। আমাদের বংশটি সে রকম। আমাদের সাথে যারা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কাজ করে, কবর সিজদা করে— তাদের সাথে আকিদার দিক দিয়ে আমাদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।’

হেফাজতে ইসলামীর মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর দিকে ইঙ্গিত করে নদভী বলেন, ‘বলা হচ্ছে একজন আলেম জমাত (জামায়াতে ইসলামী) করেন না। আমি উনাকে জমাত করেন— কখনো বলি নাই। কিন্তু হযরত আল্লামা আহমদ শফী সাহেবের জানাজায় খাটিয়া কারা নিয়েছেন, কীভাবে নিয়েছেন, কার নির্দেশে নিয়েছেন— এগুলো সব আমরা জানি। এসব আলামত কী বোঝায় আপনারা ভালোভাবে জানেন।’

এরপর সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে উদ্দেশ্য করে নদভী বলেন, ‘আমাকে নিয়ে এসব বলার কোনো গুরুত্ব নেই। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি ডাইরেক্ট। আমি নৌকার এমপি। আপনি নৌকার এমপি না। আপনি তরিকত ফেডারেশন। আমি নৌকার এমপি, আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিনিধি। আমাকে আপনি কী বলবেন? আমাকে এগুলো বলে লাভ কী? আপনি আল্লামা আহমদ শফী সাহেবকে সংসদে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করেছেন এবং চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন বাহাস করবেন। সংসদে আপনার পরপরই আমি বক্তৃতা দিয়েছি। এবং আল্লামা আহমদ শফী যে একজন শায়খুল ইসলাম, পুরো পৃথিবীর বড় মাপের আলেম হযরত মওলানা হোছাইন আহমদ মাদানীর খলিফা ও সাগরেদ সেই আল্লামা শফি সাহেবের ব্যাপারে অশ্লীল ভাষায় কথা বলা কোন সময় কাম্য নয়।’

আল্লামা আহমদ শফীকে নিয়ে ভান্ডারীর অশালীন গালি দেওয়া নিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আল্লামা আহমদ শফীকে গালি দেওয়া মানে মওলানা হোছাইন আহমদ মাদানীকে গালি দেওয়া। আপনাদের এটা জানা দরকার, ভারতবর্ষকে ইংরেজ থেকে মুক্ত করার জন্যে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন মুসলমানরা। মুসলমানদের মধ্যে সব থেকে বেশি ভূমিকা রেখেছেন আলেম ওলামারা। ওসব আলেম ওলামা কারা? আকায়েদে দেওবন্দ (দেওবন্দের অনুসারীরা), মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি, মাওলানা রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি, মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি, হোছাইন আহমদ মাদানী— ইনাদের নেতৃত্বে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। উনাদের ব্যাপারে কথা বলা, উনাদের সমালোচনা করাটা কাম্য নয়। আল্লামা আহমদ শফীকে গালি দেওয়া মানে মওলানা হোছাইন আহমদ মাদানীকে গালি দেওয়া।’

এরপর সাংসদ নদভী নিজের বিষয়ে বলেন, ‘আমি তো বাংলাদেশের সব জায়গায় যাবো, কেউ নিষেধ করতে পারবে না। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায়, ৪৮৭টি উপজেলায় আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের মসজিদ রয়েছে, মাদ্রাসা রয়েছে, টিউবয়েল রয়েছে, পল্লী রয়েছে, ওআইসি পল্লী রয়েছে, কাতার পল্লী রয়েছে, আরব আমিরাত পল্লী রয়েছে— বিভিন্ন ধরনের পল্লী রয়েছে। এগুলো দেখাশোনা করার জন্য আমি বাংলাদেশের সব জায়গায় যাবো। আমি টুঙ্গিপাড়া এবং কোটালিপাড়ায়ও যাই। আমাকে তো কেউ নিষেধ করে না। সব জায়গায় আমাকে রিসেপশন দেয়। সুন্দরভাবে রিসিভ করে আমাকে। ওসব প্রজেক্ট দেখার জন্ যতো আমাকে যেতেই হবে। আমি ফটিকছড়িতেও এক হাজারবার যাবো। ফটিকছড়িতে আমার ১২-১৪টি মসজিদ আছে।’

নাজিরহাট বড় মাদ্রাসাসহ ফটিকছড়ি-নাজিরহাট এলাকার কওমি মাদ্রাসাগুলোতে বেশ কয়েকবার ৫০ হাজার ডলারের চেক এবং বিদেশী মেহমান নিয়ে একাধিকবার গিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন সাংসদ নদভী। মাদ্রাসাগুলোতে বিদেশী সাহায্য বন্ধ হয়ে গেলে সাংসদ নদভী চিঠি দিয়ে আবার বিদেশি সাহায্য চালু করেছেন— এমন দাবি করে তিনি বলেন, ‘এসব মাদ্রাসার সাথে আমার সম্পর্ক এভাবে হয়েছে।’ এসব মাদ্রাসায় তাফসীর, সুন্নাহ, ফিকাহ, ইসলামের ইতিহাস ও আদবে আরবীর উপর লেকচার দেওয়ার কথাও উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি লেকচারও দিতে থাকবো, সাহায্যও করতে থাকবো দেওবন্দের মাদ্রাসাগুলোতে। কেউ আমাকে নিষেধ করতে পারবে না, আপনিও (ভান্ডারী) নিষেধ করতে পারবে না। আমি যাবো, শিগগিরই আবার যাবো সাহায্য করার জন্য ওখানে। লেকচার দেওয়ার জন্য আবারও যাবো। আপনি এভাবে আমাকে নিষেধ করতে পারবেন না।’

এরপর সাংসদ নদভী নিজের পিতার নামে গড়া আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তার ওপর আস্থার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে একাধিকবার দায়িত্ব দিয়েছেন রোহিঙ্গাদেরকে আরব বিশ্ব থেকে ফান্ড এনে সাহায্য করার জন্য।

সাংসদ ভান্ডারীকে উদ্দেশ্য করে নদভী বলেন, ‘দেওবন্দ তরিকার আলেমরা নিজেরাই শুদ্ধ, নেককার, আল্লাহওয়ালা। তাদের মূল্যায়ন বা সত্যায়িত বা সার্টিফাই করতে অন্য মানুষ দরকার নেই। আপনার মতো ব্যক্তির বলার দরকার নেই যে দেওবন্দ তরিকার অমুক অনেক বড়, অনেক বড়। উনার নিজেরাই অনেক বড়। আল্লাহতা’লার কাছে উনারা অনেক বড়। যারা বেদাত করে, শিরক করে তাদের সাথে আমাদের আকিদার দিক দিয়ে কোনো মিল নেই।’

নদভী বলেন, ‘আমাদের কওমিদের সাথে যদি আপনি বেশি মহব্বত (ভালোবাসা) রাখেন তাহলে আপনি হেফাজতের আমির হয়ে গেলে বেশি ভালো হবে। আমিরে হেফাজত, আল্লামা আহমদ শফী সাহেব মারা গেছেন, আপনি আমিরে হেফাজত হয়ে গেলে বেশি ভালো হবে।’

ফেসবুক লাইভের শেষ দিকে তিনি দেওবন্দের অনুসারী আলেমদেরকে সহিহ আকিদায় অটল থাকার আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি কওমি মাদ্রাসার সনদের সরকারি স্বীকৃতি, দেশব্যাপী ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ ও ইসলামী ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করায় প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেন।

নাজিরহাট মাদ্রাসায় নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর সংবাদ সম্মেলন, পাশে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।
নাজিরহাট মাদ্রাসায় নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর সংবাদ সম্মেলন, পাশে মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী।

‘সময় হইছে, আমি বের হয়ে আসছি…’
এর আগে রোববার (২৫ অক্টোবর) সন্ধ্যায় ফটিকছড়ির আল-জামিয়াতুল আরাবিয়া নছিরুল ইসলাম মাদ্রাসায় গিয়ে সেখানকার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তৃতায় স্থানীয় সংসদ সদস্য নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘আমি আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী এবং আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেবকে মুরব্বি মেনেছি। আমি আগেই বলেছি আল্লামা শফীর পর জুনায়েদ বাবুনগরীর কোনো বিকল্প নেই। সমগ্র বাংলাদেশ, সব কওমি মাদ্রাসা তার পেছনে কাতারবন্দি হয়ে গেছে।’

এ সময় বাবুনগরী পরিবারের সঙ্গে নিজের স্মৃতিচারণ করে ‘মাজারপন্থী’ হিসেবে পরিচিত এ সাংসদ বলেন, ‘আপনারা মনে হয় গোপন তথ্য জানেন না, আল্লামা মুহিব্বুলাহ বাবুনগরী আমার প্রাণ। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী সাহেবসহ উনারা আমার জন্য ওলামা মাশায়েখ সম্মেলন করেছিলেন। তখন জুনায়েদ সাহেব বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। আমি তখন থেকে উনারদের মধ্যেই আছি। আপনারা টের পাননি, আমি অপেক্ষা করছি, সময় হইছে, আমি বের হয়ে আসছি। জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে ছিলাম, আছি, থাকব।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!