শেষ মুহূর্তের অংকে আওয়ামী লীগ পাচ্ছে ২০১, স্বতন্ত্র লীগ ৭১, জাতীয় পার্টির ভাগে ১৫

গোয়েন্দা জরিপে ভোটের পূর্বাভাস

আগামী রোববারের (৭ জানুয়ারি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৯টি সংসদীয় আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ২০০-এর মধ্যে সীমিত থাকবে— শেষ মুহূর্তের গোয়েন্দা জরিপে এমন আভাস মিলেছে। দলটির নীতিনির্ধারণী মহলও আসনসংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যেতে নারাজ। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও নিরপেক্ষ দেখাতে ক্ষমতাসীন দলটি প্রায় ১০০টি আসন স্বতন্ত্রসহ বাকি দলগুলোর মধ্যে বিলিয়ে দিতে চায়। গোয়েন্দা জরিপের এমন পূর্বাভাস সত্যি হলে নৌকা প্রতীক পেয়েও কপাল পুড়বে অর্ধশতেরও বেশি প্রার্থীর। টানা তিন মেয়াদ ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটি এবার প্রার্থী দিয়েছে ২৬৬টি আসনে। এর বাইরে জাতীয় পার্টিকে ২৬ ও শরিকদের ছয়টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ : ২০১ আসন

‘৫% যোগ-বিয়োগ’ ধরে দেখানো গোয়েন্দা জরিপের বিশ্লেষণে সুনির্দিষ্টভাবে আভাস দেওয়া হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা ১৯০ থেকে ২১০-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।’ সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অর্থাৎ ১৫১টি বা তার বেশি আসনে যে দল জয়ী হয়, তারাই সরকার গঠন করে। এ হিসেবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠন— এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।

গোয়েন্দা জরিপের বিশদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে ১৪২ জন ‘নিশ্চিতভাবে’ বিজয়ী হবেন। দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হবেন ৪৭ জন। অন্যদিকে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে পারেন ১২ জন। এভাবে নৌকা প্রতীক নিয়ে মোট ২০১ জন সংসদে পা রাখছেন বলেই আভাস দেওয়া হয়েছে।

স্বতন্ত্র ‘লীগ’ : ৭১ আসন

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের ‘লাই’ পেয়ে ভোটের মাঠে সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছেন আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ৩০০ সংসদীয় আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন ৪৩৬ জন। হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এদের সকলেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত প্রভাবশালী নেতা। এবার বিএনপিবিহীন নির্বাচনও শেষমেশ জমেছে মূলত তাদেরই কল্যাণে। বহু আসনে শক্তিমত্তা ও জনপ্রিয়তায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে চাপে ফেলে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর ফলে বেড়েছে সংঘাতও। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৩০টি আসনে। এমনকি এসব সংঘাতে এখন পর্যন্ত মৃত্যুও হয়েছে তিনজনের।

আগে থেকেই সারা দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক আসনে আওয়ামী লীগ ও নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস মিলছিল। সর্বশেষ গোয়েন্দা জরিপেও অনেকটা এর কাছাকাছি আভাস মিলেছে। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৩৩ জন নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবেন। অন্যদিকে দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে পারেন আরও ৩৮ জন। এভাবে আওয়ামী লীগের ‘স্বতন্ত্র’ বা ‘স্বতন্ত্র লীগের’ তকমা নিয়ে মোট ৭১ জন প্রার্থী সংসদে যাচ্ছেন— এমন আভাস দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় পার্টি : ১৫ আসন

জাতীয় পার্টি এবার ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে তাদের ‘মিত্র’ জাতীয় পার্টিকে। আসনগুলো হচ্ছে— ঠাকুরগাঁও-৩, নীলফামারী-৩ ও ৪, রংপুর-১ ও ৩, কুড়িগ্রাম-১ ও ২, গাইবান্ধা-১ ও ২, বগুড়া-২ ও ৩, সাতক্ষীরা-২, পটুয়াখালী-১, বরিশাল-৩, পিরোজপুর-৩, ময়মনসিংহ- ৫ ও ৮, কিশোরগঞ্জ-৩, মানিকগঞ্জ-১, ঢাকা-১৮, হবিগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ফেনী-৩, চট্টগ্রাম-৫ ও ৮ এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন। এসব আসনে আওয়ামী লীগ কর্তৃক মনোনীত প্রার্থীদের প্রত্যাহার করা হলেও সেখানে তাদের কঠিন চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এর প্রভাবে জাতীয় পার্টির অন্তত ১০ জন প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার ও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন ইতিমধ্যে।

তবে গোয়েন্দা জরিপে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের ছেড়ে দেওয়া ২৬টি আসনের মধ্যে অন্তত ১৫টি আসন পেতে পারে জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে ৬ জন প্রার্থী নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবেন। দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হবেন আরও ৬ জন। অন্যদিকে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হতে পারেন তিনজন প্রার্থী। এভাবে ১৫ জন সংসদ সদস্য জোগাড় করা গেলে জাতীয় পার্টি প্রধান বা দ্বিতীয় বিরোধীদলের তকমা পেতে পারে।

অল্প আসন শরিক দলের ভাগে

১৪ দলের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি দুটি, জাসদ তিনটি ও জাতীয় পার্টি (জেপি) একটি আসন পেয়েছে। তাদের জন্য বগুড়া-৪, রাজশাহী-২, কুষ্টিয়া-২, বরিশাল-২, পিরোজপুর-২ এবং লক্ষ্মীপুর-৪ আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ।

ওয়ার্কার্স পার্টি এবার ২৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে দুটি আসন ১৪ দলের শরিক হিসেবে দলটিকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এগুলো হচ্ছে— বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) ও রাজশাহী-২ আসন। এর মধ্যে প্রথমটিতে লড়ছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, পরেরটিতে আছেন সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা।

গোয়েন্দা জরিপে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে একটি আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবেন।

বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবারের নির্বাচনে ১৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। এর মধ্যে নিজ জন্মভূমি চট্টগ্রামের হাটহাজারী ছেড়ে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে গিয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। স্থানীয় ও জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থনও তিনি পেয়েছেন। গোয়েন্দা জরিপেও কল্যাণ পার্টি থেকে নিশ্চিতভাবেই একজন জিতবেন— এমন আভাস দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ কংগ্রেস নামের প্রায় অপরিচিত দলটি ৯৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান কাজী রেজাউল হোসেন। গোয়েন্দা জরিপের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দলটি থেকে একজন প্রার্থী নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবেন।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (বিএনএফ) ৪৫টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। গোয়েন্দা জরিপের বিশ্লেষণে অবশ্য দলটি থেকে কোনো প্রার্থী নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হবেন— এমন আভাস দেওয়া হয়নি। তবে দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলটির একজন প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন বলে বিশ্লেষণে জানানো হয়েছে।

এছাড়া ছোট ছোট অন্য দলগুলো থেকে দুটি আসনে ‘দ্বিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা’য় দুজন প্রার্থী এবং ‘ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা’য় একজন প্রার্থী বিজয়ী হতে পারেন বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ছয়টি আসনে কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে মন্তব্য করা হয়নি ওই জরিপের বিশ্লেষণে।

লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, জরিপের বিশ্লেষণে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি।

২৮ দলের ১৫৩৪ প্রার্থী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ২৯৯ আসনে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এক হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী। ২৮টি রাজনৈতিক দলের হয়ে লড়াই করছেন এক হাজার ৫৩৪ জন প্রার্থী। তালিকায় দেখা গেছে, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী ১৩৫ জন, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২ জন, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশের ৩৯ জন, ইসলামী ঐক্যজোটের ৪২ জন, কৃষক শ্রমিক জনতা-লীগের ৩০ জন, গণফোরামের নয়জন, গণ-ফ্রন্টের ২১ জন, জাকের পার্টির ২১ জন, জাতীয় পার্টির (জেপি) ১৩ জন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) ৬৬ জন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের ১০ জন, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের ৩৫ জন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের ১১ জন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির পাঁচজন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জন, বাংলাদেশ ত্বরিকত ফেডারেশনের ৩৮ জন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) পাঁচজন, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট—বিএনএফের ৪৫ জন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগের চারজন, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৭৯ জন, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ৬৩ জন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) চারজন এবং গণতন্ত্রী পার্টির দশজন প্রার্থী ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। হাতেগোনা কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এসব প্রার্থীর সকলেই নগণ্য ও অপরিচিত।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!