রাউজানের রংমিস্ত্রি বাপ্পু বড়ুয়া শহরে এসেই আমদানিকারক, জাল স্ট্যাম্প আনতেন চীন থেকে

দুই বছরে ছাড়িয়ে নিয়েছেন আরও সাত চালান

চীন থেকে সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প এনে ১৪৩ কোটি আত্মসাতের চেষ্টার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। এই ঘটনায় চট্টগ্রামের বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও ফৌজদারি মামলা দায়ের হওয়ার পর এবার জানা গেল প্রতিষ্ঠানটির মালিক বাপ্পু বড়ুয়া ছিলেন চট্টগ্রামের রাউজানের রং মিস্ত্রি। সর্বশেষ সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে ভ্যাট গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চীন থেকে সিগারেটের জাল স্ট্যাম্পের আমদানিকারক রাউজানের রং মিস্ত্রি বাপ্পু বড়ুয়া গ্রামে রঙের কাজ করতেন মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে। চট্টগ্রাম শহরে এসেই তিনি রাতারাতি হয়ে যান আমদানিকারক। কাগজ আমদানির আড়ালে করতেন জাল স্ট্যাম্প আমদানি। গত দুই বছরে এই বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ কাস্টমস হাউস থেকে এ ধরনের সাতটি চালান খালাস করে নিয়ে গেছে। সর্বশেষটিই কেবল ধরা পড়েছে।

রাউজানের রংমিস্ত্রি বাপ্পু বড়ুয়া শহরে এসেই আমদানিকারক, জাল স্ট্যাম্প আনতেন চীন থেকে 1

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাপ্পু বড়ুয়া রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়নের শাক্য মাস্টারের বাড়ির মৃত সুলীল বড়ুয়ার ছেলে। নিজের নামের সাথে মিল রেখেই ‘বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ’। এখন পর্যন্ত এই নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব মেলেনি। আন্দরকিল্লার ঠিকানাটিও ভুয়া।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার জিএ ভবনের ঠিকানায় বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামের কোনো প্রতিষ্ঠান খুঁজে পায়নি শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও। রাউজানেও তার পরিবারের কেউ থাকে না। তবে বাপ্পু বড়ুয়ার জাতীয় পরিপয়পত্রে বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করা আছে।

যোগাযোগ করা হলে রাউজানের বিনাজুরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুকুমার বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাপ্পু বড়ুয়ার বাবাকে আমি চিনতাম। তেমন সচ্ছল পরিবার ছিল না। বাপ্পু বড়ুয়া ছেলেটি রঙের কাজ করতো বলে শুনেছি। রাতারাতি কিভাবে কাগজের আমদানিকারক হয়ে গেলো তা আমি ভেবে পাচ্ছি না। আমার মনে হয়, বাপ্পু বড়ুয়ার পেছনে প্রভাবশালী কারও হাত রয়েছে।’

একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল বড়ুয়া বলেন, ‘বাপ্পু একসময় রং মিস্ত্রির হেলপার ছিল। পরে ‘কন্ট্রাক্ট’ নিয়ে রঙের কাজ করতো। সে জাল স্ট্যাম্পের আমদানিকারক শুনে আমরাও আশ্চর্য হয়েছি।’

চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লার জিএ ভবন ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইকবাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ কোনো মাফিয়া প্রতিষ্ঠান হতে পারে— যাদের কোনো নাম-ঠিকানা থাকে না, যা থাকে তার সবই ভুয়া। তার পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া চক্রের হাত থাকতে পারে। বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ জিএ ভবনের ঠিকানা ব্যবহার করে অবৈধ কাজে জড়িয়ে ব্যবসায়ীদের সম্মানহানি করেছেন।’

জাল স্ট্যাম্পের পণ্যচালানটি খালাসের দায়িত্বে ছিল চট্টগ্রামের সিএন্ডএফ এজেন্ট মধুমতি এসোসিয়েটস লিমিটেড। এই সিএন্ডএফ এজেন্সির মালিক মোহাম্মদ বাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বাপ্পু বড়ুয়া মুখচেনা চিনতাম। তার আচার-আচরণে ব্যবসায়ী বলে মনে হতো। সে আমাদের মিথ্যা বলে ফাঁসিয়েছে।’

গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের একটি বিশেষ টিম মিথ্যা ঘোষণায় ‘এ-৪ পেপার’ ঘোষণায় জাল ব্যান্ডরোল খালাসের সময় আমদানিকারক বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের একটি পণ্য চালান আটক করে। চালানটি চীন থেকে আমদানি করা হয়। ওই চালানে ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার পিস সিগারেটের হালকা খয়েরি রঙের জাল স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। যা ১০ শলাকাবিশিষ্ট সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারের উপযোগী। এ চালান খালাস হয়ে গেলে ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি টাকা।

এদিকে জানা গেছে, গত দুই বছরে কাস্টমস হাউস থেকে এ ধরনের সাতটি চালান খালাস করে নিয়ে গেছে এই বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ। চীনের শেনজেন শহরের ‘ডিজি এন্টি-ফেইক কোম্পানি লিমিটেড’ থেকে আমদানি করা হয় এসব জাল স্ট্যাম্প। সাম্প্রতিক ঘটনার পর ওই কোম্পানি থেকে আমদানি করা যেকোনো পণ্যকে কড়া নজরে রেখেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস।

ভ্যাট গোয়েন্দাদের প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, চট্টগ্রামের বাপ্পু এন্টারপ্রাইজ নামের প্রতিষ্ঠানটি ইতিপূর্বেও সিএন্ডএফ এজেন্ট মধুমতি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সহায়তায় সাতটি বিল-অব-এন্ট্রি-তে ‘এ-৪ পেপার’ ঘোষণায় পণ্য খালাস করেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যে, এ প্রতিষ্ঠানটি ওইসব চালানেও একই ধরনের জাল ব্যান্ডরোল খালাস করেছে। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কোন্ কোন্ সিগারেট ফ্যাক্টরি ওইসব ব্যান্ডরোল ব্যবহারের মাধ্যমে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দিয়ে থাকতে পারে তা অনুসন্ধান করবে তদন্ত কমিটি।

চট্টগ্রামের ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ আকবর হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যান্ডরোল জাল করার বিষয়ে চট্টগ্রামে অন্য কারো হাত আছে কি-না বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এটি সরাসরি ভ্যাট ফাঁকি। এ ধএনর অপরাধের জন্য এক চুলও ছাড় দেওয়া হবে না।’

আরাফাত এন্টারপ্রাইজ ও বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাব তলব
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দরে সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প আটকের ঘটনায় ভ্যাট গোয়েন্দা পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। সোমবার (২০ ডিসেম্বর) বিষয়টি নিশ্চিত করে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প আটকের ঘটনায় ভ্যাট গোয়েন্দার পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে দুই প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করে শীঘ্রই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি তদন্তের জন্যে ভ্যাট যুগ্মপরিচালক মোহাম্মদ শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- মুনাওয়ার মুরসালীন (উপ-পরিচালক), আলমগীর হুসেন (সহকারী পরিচালক), মাশরেকী ইলিয়া কাজান (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা) এবং আব্দুল আউয়াল (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা)।

কমিটি কর্তৃক অনুরূপ অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের জুবলী রোডের আরাফাত এন্টারপ্রাইজ বিগত সময়ে একই সিএন্ডএফ এজেন্ট মধুমতি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সহায়তায় ৬টি বিল-অব-এন্ট্রি-তে ‘এ-৪ পেপার’ ঘোষণায় পণ্য খালাস গ্রহণ করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটির সার্বিক তথ্য পর্যালোচনা করে শীঘ্রই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার প্রচেষ্টায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সিগারেট খাত থেকে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট রাজস্ব আহরণ করে। সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে বাজারজাতকরণের প্রাক্কালে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ব্যান্ডরোল প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!