বাবর আলির বদলে যাওয়া

ঘা-ঘা-ঘা..ঘা… খালে সন্তরণশীল হাঁসেরা যখন একটানা ফুর্তি আর আনন্দ-উল্লাস করে, বাবর আলি তন্ময় হয়ে শোনে। এখন ছ’শো হাঁস তার খামারে। বেশিরভাগেরই গায়ের রং দুধসাদা; কিছু সাদা-কালোর মিশেল, কিছু বাদামি-খয়েরি। বাবার আলি অনেকক্ষণ ধরে খালের পাড়ে বসে থাকে। হাঁসেদের ঘা-ঘা গান শুনতে আর ডানামেলে সাঁতারকাটা দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। নিজের অজান্তেই কখন ফেলে-আসা দিনের স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে যায় সে।

বাবর আলি সবে বিএ পাশ করে বাড়ি এসেছে। এমএ পড়ার ইচ্ছে। কিন্তু বাপটা হঠাৎ করে মারা যাওয়ায় সব ওলট-পালট হয়ে গেলো। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে-সন্তান সে। ছোটো দুই বোনের একজনের বিয়ে হয়ে গেছে, অন্যজন ক্লাস এইটে পড়ছে। বাবা একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, সাথে ছিলো কিছু পৈতৃক জমি। সেখান থেকেও কিছু আসতো। এখন বাবার মৃত্যুর পর মা চারদিক অন্ধকার দেখেন। তিনি রাতদিন চোখের জল ফেলেন। মায়ের এই অবস্থা দেখে বাবর আলি এমএ পড়ার চিন্তা বাদ দিয়ে নিজে আয়রোজগারের চিন্তা করে। তাদের সামান্য যেটুকু মাঠান জমি ছিলো, বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে বিক্রি করতে হয়েছে। এক কঠিন বাস্তবতা তার চারপাশ ঘিরে থাকে।

সারাদিন উপজেলা সদরে, জেলা সদরে পই পই করে ঘোরে বাবর আলি— একটা চাকরি পাওয়ার আশায়। পেপারে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে ঢাকায়ও নানা জায়গায় দরখাস্ত করে। কিন্তু কোথাও কিছু হয় না। সারাদিন পর ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর নিয়ে বাড়ি ফেরে বাবর আলি। এভাবে দুটি বছর কেটে যায়। এখন সে খুবই ক্লান্ত। মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না। জীবনের প্রতি ভয়ানক বিতৃষ্ণা জন্মে তার।

এক দিনের কথা। আজ আর বের হয়নি বাবর আলি। বিকেল বেলা। বাড়ির সামনের আমতলায় দাঁড়িয়ে সাতপাঁচ ভাবছে সে। এমন সময় সামনের রাস্তায় একটা রিকশা ভ্যান দেখা গেলো। পেছনে মাইকের চোঙা লাগানো। ভ্যানে একটা ছেলে মাইক্রোফোনে প্রচার করছে: সুবর্ণ সুযোগ। ভাগ্য বদলের সুবর্ণ সুযোগ। উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসে তিন মাসব্যাপি যুব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন। স্বাবলম্বী হোন। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ুন। ভাইসব…

তীব্র এক স্রোত বয়ে গেলো বাবর আলির সারা শরীরে। সে এগিয়ে যায় ভ্যানের কাছে। তাকে দেখে ভ্যানের ছেলেটি একটা পোস্টার ধরিয়ে দেয় বাবর আলির হাতে। ঘোরলাগা মানুষের মতো পোস্টার হাতে টলতে টলতে ঘরে আসে বাবর আলি। পোস্টারের ওপর চোখ বোলায়। তাতে লেখা: মৎস্য চাষ. হাঁসমুরগি পালন, বনায়ন, মাসরুম এবং সবজি চাষের ওপর প্রশিক্ষণ শুরু হবে আগামী মাসের ১ তারিখ থেকে। প্রশিক্ষণের মেয়াদ তিন মাস। প্রশিক্ষণ চলাকালে মাসে দেড় হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হবে। যারা সফলভাবে প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করবেন, তাদেরকে এককালীন পুঁজি দেওয়া হবে একলক্ষ টাকা করে।

পোস্টার পড়ার পর বাবর আলির চারপাশ থেকে যেন সব অন্ধকার সরে যায় মুহূর্তে। সেখানে লাল-নীল আশার আলোরা যেন শত সূর্যের হাসি নিয়ে খেলা করতে থাকে। উত্তেজনায় সারা শরীর কাঁপতে থাকে তার। এখন বিকেল, অফিস টাইম প্রায় শেষ। না হলে এখনই যুব উন্নয়ন অফিসে চলে যেতো বাবর আলি। তা আর হয় না। চরম উত্তেজনায় রাত কাটে। সকাল হতেই কাগজপত্র নিয়ে বের হয় সে। মাকে শুধু বলে: মা, দোয়া কোরো। আসি।

বাবর আলি চলে যায়। প্রায় প্রতিদিনই তো সে এভাবে যায়। তাই মা কিছু বলেন না। শুধু রোজকার মতো প্রাণভরে দোয়া করেন আর আঁচলের প্রান্ত দিয়ে চোখের পানি মোছেন। এদিকে বাবর আলি উপজেলা সদরে গিয়ে উপজেলা যুব উন্নয়ন অফিসারের সাথে কথা বলে। বাবর আলির সব কথা শুনে আর কাগজপত্র-সার্টিফিকেট দেখে অফিসার তখনই তার নাম প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে এন্ট্রি করে নেন। তারপর যথারীতি প্রশিক্ষণ হলো তিন মাস। প্রশিক্ষণে বাবর আলি এত ভালো করলো যে, স্বয়ং ডিসি সাহেব সনদ বিতরণী অনুষ্ঠানে তাকে কিছু বলার জন্য আহ্বান জানালেন।

বক্তৃতায় বাবর আলি তার জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলল: আমরা লেখাপড়া শিখে কেবল চাকরির ধান্ধায় ঘুরি। এটা ঠিক না। যুব উন্নয়নের একটি পোস্টার আমার চোখ খুলে দেয়। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি— আমি পারব; আমরা পারব। জীবনের মোড় বদলে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর তথা সরকারের এই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। প্রশিক্ষণকালীন একটা কথা আমার খুব মনে পড়ছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে একটা বুকলেট বিলি করা হয়, যেখানে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেছেন: ‘‘একটি কথা প্রচলিত আছে যে, বয়স্ক ব্যক্তিরা ইতিহাস লিখেন কিন্তু যুবসমাজ ইতিহাস তৈরি করে।’ যুবসমাজই একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুবসমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণ তাই অপরিহার্য। উন্নয়নের রিলে রেসে যুবসমাজই বয়স্কদের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। যুবসমাজ বলবান, আত্মবিশ্বাসী, সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল শক্তি। তাদের আছে স্বপ্ন, আছে নতুনের প্রতি আসক্তি এবং আশা-আকাঙ্খা। তারা চঞ্চল কিন্তু বেগবান। যুবসমাজের আত্মপ্রত্যয় ও গতিময়তাকে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ ও কাজে লাগাতে পারলে উন্নয়নের গতিপথ হবে পরিশীলিত ও সতেজ। যুবসমাজকে তাই জাতীয় উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে সম্পৃক্ত করা অপরিহার্য।

‘‘জাতীয় যুবনীতি অনুসারে বাংলাদেশের ১৮-৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠীকে যুব হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এ বয়সসীমার জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ; যা আনুমানিক ৫ কোটি। জনসংখ্যার প্রতিশ্রুতিশীল, উৎপাদনমুখী ও কর্মপ্রত্যাশী এই যুবগোষ্ঠীকে সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল এবং দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়াধীন যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর নিরলসভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশের জনসংখ্যার সম্ভাবনাময় এ অংশকে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে তাদের মাঝে গঠনমূলক মানসিকতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা এবং সুশৃঙ্খল কর্মীবাহিনী হিসেবে দেশের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত করার অনুকূল ক্ষেত্র তৈরির উদ্দেশ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর শুরু থেকেই বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে যার সুফল ইতোমধ্যে জাতীয় কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে।’’

বাবর আলির বক্তৃতার পর সবাই তুমুল হাততালিতে তাকে অভিনন্দিত করে। ডিসি সাহেব খুশি হয়ে বাবর আলিকে নগদ দশ হাজার টাকা পুরস্কার দিলেন। বাবর আলি মোট একলক্ষ দশ হাজার (নগদে দশ হাজার আর একলক্ষ টাকার চেক) নিয়ে বাড়ি এলো। মাকে খুলে বলল সব। মা তখনই জায়নামাজে বসে গেলেন ছেলের জন্য দোয়া করতে।

পরদিন ব্যাংকে গিয়ে সে চেক জমা দেয়। সেই থেকে শুরু। আর পেছনে ফিরে তাকায়নি বাবর আলি। ওদের বাড়ি খালের পাড়ে হওয়ায় হাঁসের খামার করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। প্রথমে তিনশ হাঁস দিয়ে শুরু করে। হাঁসের খাওয়ার জন্য ধান কেনে। এভাবেই শুরু করে। এখন হাঁসের সংখ্যা ছয়শো। প্রতিদিন গড়ে আড়াই থেকে তিনশ ডিম পাচ্ছে। সহকারী হিসেবে একজন লোক রেখেছে। পাশাপাশি মাঠে মাছের ভেড়ি করেছে, যেখানে রয়েছে হরেক পদের মাছ— রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি। ভেড়ির পাড় বরাবর আছে নানাজাতের সবজি ও উন্নতজাতের বরই, পেয়ারা ও আমগাছ। কলাগাছও লাগিয়েছে শ-দুয়েক— খালের পাড় বরাবর।
সব মিলিয়ে বাবর আলির জীবন এখন আমূল বদলে গেছে। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে সব খরচখরচা বাদে তার মাসিক আয় এখন আশি থেকে নব্বই হাজার টাকা। এরই মধ্যে বিয়েও করেছে। সোনার টুকরো একটা ছেলে হয়েছে তার। আধো-আধো কণ্ঠে ছেলেটি যখন আব্বা বলে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তখন বড্ড ভালো লাগে বাবর আলির। মনে হয়— এর চেয়ে সুখ পৃথিবীতে আর কিছু নেই।

পিআইডি ফিচার

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!