বাতাসের বিষে বিপন্ন চট্টগ্রাম, চসিক-ওয়াসা-পরিবেশ নির্বিকার

সাদা পোশাক পরে রাস্তায় বের হলে তা যেমন ধূসর হচ্ছে, তেমনি কালো পোশাকও মুহূর্তে একই রং ধারণ করছে। আর এ সবই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মারাত্মক বায়ুদূষণের ‘কারিশমা’। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন নগরীর বাসিন্দারা। এ জন্য নগরীর বাসিন্দারা দুষছেন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সেবা সংস্থাগুলোকে। তবে এজন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেে নানা বিরূপ মন্তব্য আসছে এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

ঢাকায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে বায়ু দূষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা করলেও চট্টগ্রামে সেই ধরনের কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অথচ চলতি মাসেই চট্টগ্রামের বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার ছিল এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সেও বা একিউআই ২৫৬। যেটিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বলছেন, অসহনীয় ও খুবই অস্বাস্থ্য্কর। এ মাসের কয়েকটি দিন ছাড়া বেশিরভাগ দিনই চট্টগ্রাম নগরীর বাতাসের কিউআইয়ের পরিমাণ ছিল সহনশীলতার বাইরে। তবুও নির্বিকার দায়িত্বশীল সংস্থা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়রা বলছেন, বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় শীতকালে শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়া এবং ইটভাটার কালো ধোঁয়া বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। তবে চট্টগ্রাম নগরীতে বায়ু দূষণের প্রধানতম কারণ হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক সংস্কার, সম্প্রসারণ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কারণে বাতাসে ধুলিকণার পরিমাণ বেড়েছে, যা ধুলোবালির সৃষ্টি করে।

বিশেষ করে নগরীর আরকান সড়ক, বহদ্দারহাট, চকবাজার, জামালখান, নন্দনকানন, আগ্রাবাদ একসেস রোড, হালিশহর, বাকলিয়া, পোর্ট কানেকটিং রোড, বন্দর, পতেঙ্গা ইপিজেড থানা এলাকাসহ অনেক জায়গায় অসহনীয় বায়ু দূষণ হচ্ছে। আবার ড্রেন সংস্কার বা নালা-নর্দমা পরিষ্কারের সময় তোলা মাটি নালার পাড়েই দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়। সেগুলোও সৃষ্টি করছে ধুলা। এসব জায়গায় চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপলাইন সংস্কারের কারণে খোঁড়াখুঁড়ি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের চলমান সড়ক উন্নয়ন কাজের কারণেই নগরীর বাতাসে ধুলোবালির পরিমাণ বেড়ে গেছে। এসব সড়কে চলাফেরা রীতিমত দায় হয়ে পড়েছে। চলতে গেলেও মুখে মাস্ক পড়েই বাসা থেকে বের হতে হচ্ছে। ধুলোবালি কারণে চর্ম হাঁপানিসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে নগরীর অধিকাংশ মানুষ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিমাপক অনুযায়ী, বাতাসের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের মাত্রা ১৫১-এর উপরে উঠলে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। একিউআইর মাত্রা ১৫০ থেকে ২০০ পিপিএম হলে ‘অস্বাস্থ্যকর’ । ২০১ থেকে ৩০০ পিপিএম ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ এবং মাত্রা ৩০১ থেকে ৫০০ পিপিএম ‘চরম পর্যায়ের অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

বাতাসের বিষে বিপন্ন চট্টগ্রাম, চসিক-ওয়াসা-পরিবেশ নির্বিকার 1

পরিবেশ অধিদপ্তরের কেইস প্রকল্পের আওতায় প্রতিদিন বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে। তাদের ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর বায়ুর মান পরীক্ষা করা হয়েছে। তা হলো নিম্নরূপ— ১০৮, ১২২, ১২২, ১৪৭, ১৪৬, ২৫৬, ১০৬, ২৬, ৫৯, ৩৩, ২৫, ৯৪, ৫৩, ৪১, ৬৮, ৮২, ১২১, ১৯২, ১৯৩, ডিএনএ, ১২৩, ১১১, ৮৭, ১০৩, ১১২ একিউআই। সেই হিসেবে কয়েক দিন চট্টগ্রামের বাতাসের বায়ুমান সহনীয় থাকলেও এ মাসের ৬ তারিখ তা ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। অন্যদিকে অন্তত চারদিন ছিল অস্বাস্থ্যকর।

চট্টগ্রামের সদ্যবিদায়ী সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘চট্টগ্রামে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে ধুলাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ। ধুলাবালির কারণে বাচ্চারাই সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে রোগ-জীবাণু মিশ্রিত ধুলা বাতাসে ভাসমান বস্তুুকণার কারণে শিশুদের নিউমোনিয়ার মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মারাত্মক বায়ু দূষণের কারণে মানুষ প্রতিনিয়ত অ্যাজমা, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, টাইফয়েড, সর্দিকাশি, চোখের ইনফেকশন ফুসফুসের ক্যান্সারসহ মারাত্মক ক্রনিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।’

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামের পরিবেশ দূষণের মাত্রা ক্রমেই ভয়ানক পর্যায়ে যাচ্ছে। শুকনো মৌসুমে সড়কে ধুলোর দাপট কমাতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সুইপিং গাড়ি কিনলেও কোনও কাজ করছে বলে জানি না। অথচ এই বায়ু দূষণের জন্য সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেমন দায়ী তেমনি এসব সংস্থাকে মনিটরিং করতে না পারাটা সিটি করপোরেশনের দায়। এমনকি তারা সড়কে কোনও সময় পানি ছিটিয়েছে বলেও শুনিনি। অন্যদিকে পুরো দায়দায়িত্ব পরিবেশ অধিপ্তরের। ঢাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সময় বায়ু দূষণের কারণে সম্প্রতি জরিমানা করা হলেও চট্টগ্রামে এই ধরনের কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। মূল কথা হচ্ছে সরকারি এসব সংস্থার ইচ্ছার অভাব।’

বাতাসের বিষে বিপন্ন চট্টগ্রাম, চসিক-ওয়াসা-পরিবেশ নির্বিকার 2

বায়ু দূষণ রোধে করণীয় প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নির্মাণকাজের চারপাশ ঢেকে রাখা ও পানি ছিটানো, রাস্তা খোঁড়ার সময় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢেকে রাখা, স্টিল, রি-রোলিং মিলস ও সিমেন্ট কারখানাগুলোয় বস্তুকণা নিয়ন্ত্রণমূলক যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও ধুলাবালি কমাতে বাড়ির চারপাশে সবুজায়ন করা, ইটভাটায় পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার, গাড়ি ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা, যানজট এড়াতে ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং দূষণ রোধে নিয়মিত মেইনটেন্যান্স করা।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরীর পরিচালক আজাদুর রহমান মল্লিক বলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগরীতে বায়ু দূষণের জন্য বিশেষ করে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত সেবা সংস্থাগুলো যেমন দায়ী, তেমনি গাড়ির কালো ধোয়া নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়া ট্রাফিক বিভাগ ও বিআরটিরও দায় আছে। দেখি এই সমস্যা থেকে কিভাবে উত্তরণ হওয়া যায়।’

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এ দূষণকারীদের (প্রথমবারের মতো) বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ২ বছরের দণ্ড, সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। পরবর্তীতে প্রতি অপরাধের জন্য দুই থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘আমাদের ট্রাফিক বিভাগ কালো ধোঁয়ার গাড়ির বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান করছে। বায়ু দূষণরোধে যতটুকু দায়িত্ব আমাদের, ততটুকু আমরা করছি।’

চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘ওয়াসার যেসব এলাকায় সংস্কার কাজ চলছে সেসব এলাকায় ইতিমধ্যে পানি ছিটানো হচ্ছে।’

বাতাসের বিষে বিপন্ন চট্টগ্রাম, চসিক-ওয়াসা-পরিবেশ নির্বিকার 3

চট্টগ্রাম সিটি করপোরশেনের প্রধান প্রকৌশলী লে. কর্নেল সোহেল আহমেদ বলেন, ‘যেসব সড়কে ধুলোবালি উড়ছে সেই সব এলাকায় পানি ছিটানোর জন্য দুটি পানির বার্জ রাখা হয়েছে। তালিকা করে রুটিনমাফিক বিভিন্ন এলাকায় এই দুটি বার্জ থেকে পানি ছিটানো হবে।’

যদিওবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাস্তার ধুলাবালি পরিষ্কারের তিনটি ‘সুইপিং গাড়ি’ আছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক)। অবশ্য গত কয়েক বছরে একবারও ব্যবহার হয়নি। এছাড়া ১৬টি পানিবাহী বিশেষ গাড়ি ও ৭০০ পরিছন্নকর্মী রয়েছে চসিকের। তবে নগরবাসীর ভাষ্য হচ্ছে, সিটি করপোরশেন কোনও সময় নগরীর সড়কের ধুলোবালির প্রকোপ থেকে বাঁচাতে পানি ছিটায়নি এ কয়েক বছরের মধ্যে।

এদিকে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, তীব্র বায়ু দূষণের সাথে মানুষের বুদ্ধি কমে যাবার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে চীনে পরিচালিত এক নতুন গবেষণায় তথ্য উঠে এসেছে। চার বছর ধরে চীনের ২০ হাজার মানুষের ওপর এক যৌথ গবেষণা চালায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। গবেষকরা মনে করেন, এ গবেষণাটি বিশ্বব্যাপী প্রাসঙ্গিক। বিশ্বজুড়ে শহরাঞ্চলের ৮০ শতাংশ মানুষ অনিরাপদ বায়ু দূষণের মধ্যে বসবাস করছে।

বায়ু দূষণের শিকার ব্যক্তিদের গণিত এবং মৌখিক কিছু পরীক্ষা দেওয়া হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল তাদের বুদ্ধিমত্তা যাচাই করা। গবেষেকরা দেখেছেন, যারা বায়ু দূষণের শিকার তারা সেসব পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি। চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি এবং আমেরিকার ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা এ দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এ গবেষণায় তারা বায়ুতে সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এবং ১০ মাইক্রোমিটারের ছোট ধূলিকণা পরিমাপ করেন।

অন্যদিকে বায়ু দূষণকে অদৃশ্য ঘাতক হিসেবে বর্ণনা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে ৭০ লাখ মানুষ অপরিণত বয়সে মারা যায়। বায়ু দূষণের কারণে আলঝেইমারস এবং স্মৃতিভ্রমের ঝুঁকি তৈরি করে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!