চট্টগ্রামজুড়ে তামাকের বিষাক্ত জাল

আইন মানছে না কেউই, নজরদারিও নেই

ধুমপানের প্রচারণা, পৃষ্ঠপোষকতা ও বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছে না কেউই। নগরজুড়ে প্রশাসন, আদালত, হাসপাতাল, ক্লিনিক, নগরীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুমপানের বিজ্ঞাপন ও বিক্রি থেকে মুক্ত নয়। দিনের পর দিন এভাবেই বাড়ছে তামাকের বিষাক্ত জাল।

তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, বিক্রি ও প্রচারণা নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশ্যে বিড়ি-সিগারেট, পান জর্দা বিক্রি ঠেকানো যাচ্ছে না। নতুন নতুন ধুমপায়ী সৃষ্টি করতে তামাক কোম্পানিগুলো নানা কৌশলে উপটৌকন ও প্রণোদনা দিয়ে তরুণদের আকৃষ্ট করছে। তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫ নম্বর ধারায় বলা আছে- কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ধারার বিধান লংঘন করলে অনুর্ধ ৩ মাস কারাদন্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগরীর কোথাও এই আইনের প্রয়োগের ঘটনা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ও ব্যবহার বন্ধে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), সিভিল সার্জন কার্যালয়, শিক্ষাবোর্ডের মতো তদারককারী প্রতিষ্ঠানের কোনো তৎপরতাই নেই। তামাকজাত বিক্রয় কেন্দ্রগুলো লাইসেন্স না নেওয়ায় চসিক একাই বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে।

জরিপে ভয়ানক চিত্র

সম্প্রতি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) জরিপে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও বিক্রয় কেন্দ্র সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১ অক্টোবর এবং ৬ অক্টোবর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা) কর্তৃক নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয় চিত্রের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। এই জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে তামাকজাত বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১৬ হাজার ৫৯টি। এর মধ্যে রাস্তার পাশে বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে ৩ হাজার ৩৯৪টি, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় হয় এমন চা বিক্রয় কেন্দ্র ৪ হাজার ৩০টি, ক্ষুদ্র মুদি দোকান ৫ হাজার ৮৭৯টি, সুপার মার্কেট ৯২৪টি, তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্র ৬৬৭টি, রেস্টুরেন্ট ১৯৬টি, ভাসমান বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে ৬৯৪টি। নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে লাইসেন্সবিহীন বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১১ হাজার ৪৬২টি, যা মোট বিক্রয়কেন্দ্রের ৭১ শতাংশ।

এই জরিপ থেকে আরো জানা যায়, ১০০ গজের মধ্যে তামাক পণ্য বিক্রি হয় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাটি ৮৮৫টি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ৫ হাজার ৫৩৬টি। জরিপের তথ্যমতে, ১০০ গজের মধ্যে তামাকজাত পণ্য বিক্রি হয় এমন হাসপাতালের সংখ্যা ১৬২টি। তামাকজাত পণ্য বিক্রিতে নিয়োজিত ১৮ বছরের কমবয়সীর সংখ্যা ৬৪৬ জন, যা ৪ শতাংশ। বিক্রয়স্থলে দৃশ্যমান বিজ্ঞাপন দেখা গেছে এমন বিক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১২ হাজার ১৬৫টি, যা ৭৬ শতাংশ।

ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার ও ক্রয়-বিক্রয় ও বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ আইনের ৫ (ক) এ বলা হয়েছে, প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ড বা অন্য কোনভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করিবেন না বা করাইবেন না।

তামাকবিরোধী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বৃদ্ধি, তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধে মনিটরিংয়ের দাবি জানিয়ে আসছে। নাটক ও সিনেমায় ধুমপান ও অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার প্রদর্শন নিষিদ্ধ সংক্রান্ত আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ এবং টেলিভিশন ও ইউটিউব চ্যানেলসমূহ নিয়মিত মনিটরিং ছাড়াও তামাক পণ্য বিক্রেতার জন্য আইন প্রতিপালনের শর্তসহ লাইসেন্স প্রচলনের দাবিও জানিয়ে আসছে সংগঠনগুলো।

‘টোব্যাকো ফ্রি সিটি হওয়া উচিত’

বেসরকারি সংস্থা বিটার নির্বাহী পরিচালক শিশির দত্ত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ধুমপানমুক্ত দেশ করার অঙ্গীকার প্রকাশ করেছেন। এটাতে আমাদের সবারই সহযোগিতা করা উচিত। সেটাকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম টোব্যাকো ফ্রি সিটি হওয়া উচিত। আইনে আছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্র রাখা যাবে না। কিন্তু চট্টগ্রামে সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাকদ্রব্যের প্রচুর বিক্রয়কেন্দ্র আছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের ভূমিকা পালন করছে। তাই আমি মনে করি, এখানে সিটি করপোরেশনের যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর ১০০ গজের মধ্যে যেন কোন তামাকদ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্র না থাকে, সে ব্যাপারে মেয়রকে ভূমিকা রাখতে হবে।’

দায় এড়াচ্ছেন তাঁরা

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাকদ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্র সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম বলেন, ‘এটা আমাদের বিষয় নয়। এটা আইনশৃঙ্খলার বিষয়। প্রশাসন দেখবে।’

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মো. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের তো ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নেই। আপনারা যদি তালিকা দিতে পারেন, তাহলে আমরা জেলা প্রশাসক বরাবর উত্থাপন করতে পারি। উনারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন।’

প্রকাশ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয় ও প্রচারণা বন্ধে কোন ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে সিএমপি কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান বলেন, ‘এই ব্যাপারে আমাদের কার্যক্রম আছে। তবে তা মাঝেমধ্যে ধীরগতি হয়ে যায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছি।’

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন বলেন, ‘আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট সংকট আছে। এ বিষয়টি আমরা দেখবো। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার সময় তামাকজাত দ্রব্যের প্রকাশ্যে বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা বন্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১০০ গজের মধ্যে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্র থাকলে অবশ্যই সেগুলো আমরা উচ্ছেদ করবো। আমরা রাজস্ব আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ট্রেড লাইসেন্সবিহীন কোন দোকান থাকলে সেগুলোও লাইসেন্সের আওতায় আনা হবে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!