চট্টগ্রামের ‘মেট্রো প্রভাতী’ নামেই স্পেশাল সার্ভিস, পথে পথেই স্পেশাল ভোগান্তি

চট্টগ্রামে নগরবাসীর ভোগান্তি লাঘবে আশীর্বাদ হয়ে আসা স্পেশাল কাউন্টার সার্ভিস ‘মেট্রো প্রভাতী’ এখন জনদুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। ছয় বছর আগে নগরীর পতেঙ্গা থেকে কাপ্তাই রাস্তা মাথা পর্যন্ত ‘যত সিট, তত যাত্রী’ নিয়ে চলাচলের ঘোষণা দেয় তারা। কিন্তু রাস্তায় নামার কিছুদিনের মধ্যেই তারা ‘লোকাল বাসে’ পরিণত হয়। নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে দ্বিগুণ ভাড়ায় যাত্রী তুললেও গাড়ির সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়।

এছাড়া সিটের বাইরেও গাদাগাদি করে লোক নেওয়া হয় গাড়িতে। সিটগুলোর অবস্থাও বেহাল, কোনো কোনো বাসে নেই পর্যাপ্ত ফ্যান। বেশি ভাড়ায় আরামে গাড়িতে চড়তে আসা যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। এই রুটে ৫৫টি বাস চলাচলের কথা থাকলেও অকেজো পড়ে আছে ১০টি। এই বাস সার্ভিস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও ক্ষোভ ঝারছেন অনেকে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালে চালু হয় মেট্রো প্রভাতী সার্ভিস। শুরুতে বেশ সাড়া ফেলে তারা। কাপ্তাই রাস্তার মাথা থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়কে নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া এসব গাড়ি দাঁড়ায় না। সেখান থেকে খালি সিট থাকা সাপেক্ষে যাত্রী তোলা হয়। কিন্তু কয়েক বছর যেতেই যাত্রীর চাপ বাড়তে থাকে। ফলে তাদের যাত্রীর তুলনায় গাড়ির সংকট দেখা দেয়। ফলে নির্দিষ্ট কাউন্টারে সিটের বাইরেও দাঁড়িয়ে যাত্রী নেওয়া শুরু হয়।

আরও জানা গেছে, পতেঙ্গা থেকে ফিরতি পথে গাড়ি ফ্রি পোর্ট পর্যন্ত আসলেই গাড়ির সিট আর খালি থাকে না। তখন আগে থেকে অন্যান্য কাউন্টারে টিকিট কেটে রাখা যাত্রীদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে।

পতেঙ্গার স্থানীয় যুবক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘মেট্রো প্রভাতী নিজেরাই কৃত্রিম গাড়ি সংকট তৈরী করেছে। প্রায় সময় দেখা যায় কাটগড়ে তাদের খালি গাড়ির লম্বা লাইন। অথচ একটি গাড়ি কাটগড়েই ৮০ থেকে ৯০ ভাগ যাত্রী ফিলাপ হলেই তবেই গাড়িগুলো ছাড়ে। ফলে পরবর্তী কাউন্টার মহাজন ঘাটা থেকে পুরোপুরি গাড়ি ফিলাপ হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী কাউন্টার হাসপাতাল গেইট থেকে দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া শুরু।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘ওদের মূল টার্গেট দুই গাড়ির যাত্রী এক গাড়িতে করে বহন করা। আপনি যদি সুপারভাইজারের কাছে অভিযোগ করেন তাহলে তাদের সহজ উত্তর যাত্রী উঠলে আমাদের কী দোষ? অথচ তারা যদি গাড়ি কাটগড় থেকে সম্পূর্ণ ফিলাপ না করে ভাগ করে করে প্রতি কাউন্টার থেকে যাত্রী নিত তাহলে কখনোই যাত্রীদের দাঁড়িয়ে একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হতো না। এটা যাত্রীদের সাথে এক প্রকার প্রতারণা।’

পতেঙ্গা থেকে লালখানবাজার পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের সড়কে নির্মাণকাজ চলছে। ফলে যানজট লেগে থাকে প্রতিদিন। বিশেষ করে ইপিজেডে গার্মেন্টস ছুটির পর ৬, ১০ ও ১১ নম্বর গাড়িগুলো রিজার্ভ ভাড়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তখন দেখা দেয় গাড়ির সংকট। আবার কোনো কোনো গাড়ি টাইগারপাস, নিউমার্কেট, জিইসির মোড়ের পর আর যায় না। তাই বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে মেট্রো প্রভাতীকে বেছে নেয় মানুষ।

সরেজমিন মেট্রো প্রভাতীর বিভিন্ন কাউন্টার ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পতেঙ্গা থেকে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্ত শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহে ছয়দিন চলে এসব বাস। গার্মেন্টস ছুটি হলে ইপিজেডের কাজির গলি সংলগ্ন কেইপিজেড পকেট গেটে যানজট লেগেই থাকে। সল্টগোলা ক্রসিংয়ে বন্দরের মালামাল লোড-আনলোডের জন্য কন্টেইনার, লরি ও কাভার্ডভ্যানের দীর্ঘ যানজট থাকে প্রতিদিন। এছাড়া বিশ্বরোড, আগ্রাবাদ, চৌমুহনী, দেওয়ানহাট, লালখানবাজার থেকে শুরু করে কাপ্তাই রাস্তার মাথা পর্যন্তও সীমাহীন যানজট লেগেই থাকে। দ্বিগুণ দামে টিকিট কেটে গাড়িতে উঠলেও বসতে পারেন না অধিকাংশ যাত্রী। এসব গাড়িতে একাধিক ফ্যান থাকলেও প্রায়ই সচল নেই। প্রায় সময় পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও যেতে হয় দাঁড়িয়ে।

আগ্রাবাদ এলাকার নিয়মিত যাত্রী মো. মামুন। তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। একে তো যানজট, তারপর প্রচণ্ড গরম। মাথার ওপর ফ্যানও নেই। আমরা বাসচালক, হেলপার ও বাস মালিকদের কাছে জিম্মি। এদের কিছু বললে উল্টো বলবে ‘ভালো না লাগলে পরের বাসে আসবেন’। সময় বাঁচাতে গিয়ে বাধ্য হয়ে বাসে উঠতে হয় আমাদের। অনেক সময় যাত্রীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পতেঙ্গার স্থায়ী বাসিন্দা মাজহারুল ইসলাম তিতুমির নামের এক ব্যক্তি মেট্রো প্রভাতী বাস সার্ভিসে যাত্রীদের দুর্ভোগের বিষয়টি তুলে ধরেন। ‘অপরূপ পতেঙ্গা’ ও ‘প্রিয় পতেঙ্গা’ নামের দুটি ফেসবুক পেইজে বিষয়টি শেয়ার করা হয়। এরপর শুরু হয় সার্ভিস নিয়ে সাধারণ মানুষের সমালোচনা।

কাটগড় থেকে লালখানবাজারের নিয়মিত যাত্রী সাহেদ হাসান বলেন, ‘দীর্ঘযাত্রায় একটু স্বস্তি পেতে প্রভাতীতে টিকিট কেটে গাড়িতে উঠি। কিন্তু মনে হয় মেট্রো প্রভাতী দিন দিন তাদের বসার আসনগুলো সংকীর্ণ করে ফেলছে। সেখানে হাঁটু রাখার জায়গাও থাকে না। আর সিইপিজেড স্টপেজের পর থেকে আসন ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ যাতায়াত করে। তাছাড়া গাড়ির অধিকাংশ ফ্যান নষ্ট থাকে।’

‘আলোকিত পতেঙ্গা মানবিক সংগঠন’র সভাপতি মো. নেজাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আগে মেট্রো প্রভাতীর সার্ভিস ভালো ছিল, এখন সেবার মান একেবারে নিম্নমানের। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে আমরা যেন লোকাল বাসে যাতায়াত করছি। মালিকপক্ষ তাদের ব্যবসায়িক হিসেবটা ঠিকই বোঝেন। পুরোনো লক্কর-ঝক্কর গাড়ি দিয়ে যাত্রী সেবা দিচ্ছেন তারা। যাত্রীদের ভোগান্তির বিষয়টি যেন দেখার কেউ নেই।’

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ‘মেট্রো প্রভাতী যখন তাদের যাত্রা শুরু করে, তখন তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল ‘যত সিট, তত যাত্রী’। কিন্তু তারা তাদের কথা রাখেনি, এটাও এক রকম যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা। যাত্রীদের সুবিধায় বাস মালিকদের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। আসন সংখ্যার বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন—কেনা টিকিটসহ এমন অভিযোগ যদি কেউ ভোক্তা অধিকারে দেন তাহলে বিষয়টি আমরা দেখবো।’

এই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা গত ৭ বছর ধরে যাত্রীদের ভালো সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের ৫৫টি গাড়ির রোড পারমিট রয়েছে। কিছু গাড়ি পুরোনো ও নষ্ট হয়ে যাবার কারণে পুলিশ মামলা দিচ্ছে। ১০টি গাড়ি রি-মডেলিং করার জন্য দিয়েছি। আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যে সমস্যার সমাধান হবে এবং যাত্রীদের দুর্ভোগ কমবে।’

তিনি বলেন, ‘অনেক সময় আমরা নিষেধ করার পরও যাত্রীরা তাদের প্রয়োজনে গাড়িতে উঠে যায়। আমাদের নিয়মিত যাত্রীদের জন্য খুব শিগগির পাঞ্চ কার্ডের ব্যবস্থা করে দিলে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার ঝামেলা কমে যাবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!