এমন দুঃসময়ে পরিবহন শ্রমিকের পাশে নেই নেতারা, মালিকরা চিনতেও পারছেন না

গাড়ির চাকা ঘুরলে চালকের ভাগ্যের চাকাও ঘোরে— কথায় আছে এমন। গাড়ির চাকা বন্ধ, তাই চালকের আহারও জুটছে না। করোনার ঝুঁকি এড়াতে ২৬ মার্চ থেকে প্রায় এক মাস হয়ে গেল সড়কে চলাচল করছে না কোন যানবাহন। সর্বশেষ ৫ মে পর্যন্ত গণপরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও এরপরও যে খোলা হবে তারও কোনো ইঙ্গিত এখন পর্যন্ত নেই। কর্মহীন এই দুঃসময়ে চরম দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে নগরের গণপরিবহন শ্রমিকেরা। চট্টগ্রামে বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলার, টেম্পো, সিএনজি অটোরিকশা মিলে ২৮ থেকে ৩৩ হাজার গণপরিবহন শ্রমিক চরম দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। সারা বছর ওয়েবিলসহ নানা অজুহাতে কোটি টাকার চাঁদাবাজি আদায় করতেন যেসব শ্রমিক নেতা ও পরিবহন মালিক— এমন দুর্দিনে তাদের কারও দেখা নেই। নানা কর্মসূচিতে এই শ্রমিকদের নিজেদের স্বার্থে যারা ব্যবহার করতেন, এমন দুঃসময়ে তাদের কারও দেখা নেই।

এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে ত্রাণের জন্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভও করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ১৮ এপ্রিল সকালে নগরীর আগ্রাবাদের বড়পুল মোড়ে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করে কয়েকশত পরিবহন শ্রমিক। এসময় কোনো গাড়ি চলতে না দেওয়ায় পণ্য পরিবহন গাড়ি আটকে দীর্ঘ জট লেগে যায়।

করোনা ঝুঁকি মোকাবেলায় এক মাসের কাছাকাছি সময় ধরে পুরো দেশ অঘোষিত লকডাউনে রয়েছে। সড়কে কোন যানবাহন চলাচল না করায় কর্মহীন ১৫ থেকে ২০ হাজার ও ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশা চালকসহ প্রায় ২৮ থেকে ৩৩ হাজার গণপরিবহন শ্রমিক অনাহার-অভাবে দুর্বিসহ জীবনযাপন করছেন। দিনে এনে দিনে খাওয়া শ্রমিকেরা কর্মহীন সময়ের শুরুতে কোনরকমে জমানো টাকা, ধারদেনা, ঘরের আসবাব বিক্রিসহ নানাভাবে পরিবারের আহার জোগালেও দিন যতোই বাড়ছে, শ্রমিকদের অভাব-অনটনও ততো বাড়ছে। অনেক শ্রমিক পরিবার নিয়ে দিনের পর দিন না খেয়ে দিন পার করছেন। অনেকের ভাড়া বাকি হওয়ার কারণে বাড়ি মালিক বাড়ি ও মেস ছাড়তে চাপ দিচ্ছেন।

জানা যায়, চট্টগ্রামে বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও টেম্পো মিলে ১৫ থেকে ২০ হাজারের মত গণপরিবহন শ্রমিক রয়েছে। দৈনিক ট্রিপের ভিত্তিতে চুক্তি নিয়োজিত এসব শ্রমিকের নেই কোন নিয়োগপত্র। চট্টগ্রামে একজন মালিক বা সমিতির ৭৫টি থেকে শুরু করে ১০০ থেকে আড়াইশত গাড়ি রয়েছে। এসব গাড়ি মালিক বা সমিতি দৈনিক লাখ টাকা গাড়ির আয় ও ৩৫০ টাকা ওয়েবিল, শ্রমিক কল্যাণ ফাণ্ডের নামে ৩০ টাকা আদায় ছাড়াও নানা অজুহাতে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করেন। অথচ শ্রমিকদের দুঃসময়ে পাশে নেই কোন মালিক ও শ্রমিক নেতা।

জানা গেছে, নিরুপায় শ্রমিকরা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের কাছে দুঃসময়ে সহযোগিতার জন্য বার বার ধরনা দিচ্ছেন। দুএকজন মালিক ও শ্রমিক নেতা সামান্য সহযোগিতা করলেও অধিকাংশ মালিক শ্রমিক নেতাই শ্রমিকদের এড়িয়ে চলছেন। কোন ধরনের যোগাযোগ তো দূরের কথা, ফোনই ধরছেন না অনেকে। অনেকে আবার সহযোগিতার কথা বলে শ্রমিকদের দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছেন। এর মধ্যে শ্রমিকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি)। ইতিমধ্যে এস আলম গ্রুপের দেওয়া অনুদান সহ মোট সাড়ে তিন হাজার শ্রমিকের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করেছে সিএমপি।

চট্টগ্রামে মালিকদের সাতটি ও শ্রমিকদের তিনটির বাইরে আরও কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। মালিকদের সংগঠন চট্টগ্রাম মেট্রো পরিবহন মালিক সমিতি, চট্টগ্রাম সিটি বাস, মিনিবাস হিউম্যান হলার মালিক সমিতি, যাত্রী সেবা পরিবহন সার্ভিস মালিক সমিতি, লুসাই পরিবহন মালিক সমিতি, কালুরঘাট বাস, মিনিবাস মালিক সমিতি, চট্টলা পরিবহন মালিক সমিতি । অন্যদিকে শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর বাস, মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম মহানগরী হিউম্যান হলার চালক সহকারী শ্রমিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম মহানগরী হিউম্যান সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন।

একাধিক শ্রমিকের সাথে কথা বলে জানা যায়, শুরুতে কোন রকমে দিন পার করলেও গত কিছুদিন ধরে উপোসে দিন কাটাতে হচ্ছে তাদের। বাড়ি মালিকের চাপ ও পরিবার পরিজন নিয়ে চরম কষ্টে দিন পার করছে তারা।

একজন পরিবহন শ্রমিক বললেন, ‘আমরা যাদের জন্য বছরের পর পর খেটেছি, আন্দোলন করেছি তারা এখন আমাদের চিনতে পারেন না, সহযোগিতা তো দূরের কথা। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। এখন আমরা বুঝতে পেরেছি মালিক ও শ্রমিক নেতারা আমাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। বাস্তবে তারা কখনও আমাদের সহযোগিতা করে না, যা এই মহামারিতে প্রমাণ হয়েছে। এখন যাদের হয়ে আন্দোলন করেছি এই দুঃসময়ে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনে নামতে হবে। ইতিমধ্যে সিএনজি অটোরিকশা চালকেরা আন্দোলনে নেমেছে। আমাদেরকেও নামতে হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মৃণাল চৌধুরী বলেন, ‘শ্রমিকেরা দিনে এনে দিনে খায়, একদিন গাড়ি না চললে ঘরে উপোস থাকতে হয়। সেখানে প্রায় একমাস ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা দিনের পর দিন না খেয়ে আছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সরকারের পক্ষ থেকে নানা সহায়তার কথা বললেও সেখানে রয়েছে সমন্বয়হীনতা। সবমিলিয়ে শ্রমিকের পাশে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই— এটাই বাস্তবতা।’

চট্টগ্রাম মহানগর বাস, মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো নুরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনার প্রভাবে প্রায় একমাস ধরে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ায় শ্রমিকরা খুব কষ্টে দিন পার করছে। সব শ্রমিকদের সহায়তা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক মালিক নেতাদের সাথে আমি যোগাযোগ করলেও একজন ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেননি। আমি কয়েকজন মালিক নেতার সাথে যোগাযোগ করেছি যাদের ১০০ থেকে ২০০ বাস-মিনিবাস রয়েছে, অথচ তারা কোন সহযোগিতা করেননি। মালিক-নেতারা আমাদের ব্যবহার করেছেন। অথচ দুঃসময়ে শ্রমিকের পাশে নেই। আমাদের শিক্ষা হয়েছে। তা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। অনেকে সহযোগিতার কথা বলে দিনের পর দিন ঘোরাচ্ছেন। আমি আমার সংগঠনের পক্ষ থেকে যা পারছি সহযোগিতা করেছি।’

সিএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!