৪৮০০ পাড়াকেন্দ্রের ভাগ্য নিয়ে খেলছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড

বিপদে পড়বে আড়াই লাখ মানুষ

অনিশ্চয়তার ফাঁদে আটকা পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের তিন পার্বত্য জেলার পাড়া কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ। দুর্গম ও প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্রে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রায় আড়াই লাখ জনগোষ্ঠীকে মৌলিক সেবা পৌঁছানোর সুযোগ কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।

চিঠির পর চিঠি, জবাবই দেয় না পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড
চিঠির পর চিঠি, জবাবই দেয় না পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ইউনিসেফের সহায়তায় পাড়াকেন্দ্রে প্রাক-শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ, পয়ঃব্যবস্থা উন্নয়ন এবং সংক্রামক ব্যাধি, বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম, শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিষয়ক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

জানা গেছে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থাও তাদের সেবাপ্রদানমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নে এই নেটওয়ার্কের সুবিধা নিয়ে থাকে। বর্তমানে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় পাড়াকেন্দ্রগুলো চলছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত এবং এর প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৪ দশমিক ৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ৭৪ শতাংশ এবং ইউনিসেফ কারিগরি সহায়তার পাশপাশি ২৬ শতাংশ ব্যয়ভার বহন করছে।

পাড়াকেন্দ্র নেটওয়ার্ক কার্যক্রমের শুরুতে শতভাগ ব্যয়ভার ইউনিসেফ গ্রহণ করলওে ক্রমান্বয়ে সরকারের অংশভাগ বেড়েছে। বিভিন্ন নামের এসব প্রকল্পের মাধ্যমে একই কাজ দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবায়িত হতে থাকার বাস্তবতায় পরিকল্পনা কমিশন গত বছর সম্পদ ও প্রয়োজনীয় জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তর এবং বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে একটি কমিনিউটি ডেভেলপমেন্ট উইং সৃজনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালনার সুপারিশ করে। তবে আগের বোর্ড কর্তৃপক্ষ ওই সুপারিশ প্রস্তাব পাঠানোয় আগ্রহী থাকলেও বর্তমান ম্যানেজমেন্ট এ ধরনের কোনো প্রস্তাব প্রেরণে আগ্রহী নয় বলেই জানা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের একাধিক সভায় দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে বোর্ড কর্তৃপক্ষ কোন সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব না পাঠানোয় প্রকল্প কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে পাড়াকেন্দ্রের প্রায় ৬০ হাজার শিশুর প্রাক-শিক্ষা, অ্যাডোলসেন্ট ক্লাবের মাধ্যমে দেড় লক্ষ কিশোর- কিশোরীর সুস্থ জীবন চর্চা, প্রায় তিন লাখ নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ছাড়াও চারটি আবাসিক স্কুলে ১২০০ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষাজীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এরই মধ্যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতিতে প্রকল্পে কর্মরত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক ও পাড়াকর্মী নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু পাড়াকেন্দ্রের ইতিবাচক অভিজ্ঞতার আলোকে একই আদলে বাংলাদেশ সরকার ‘ইন্টিগ্রিটেড কমিউনিটি বেইজড সেন্টার ফর চাইল্ড কেয়ার, প্রটেকশন এন্ড সুইম সেইফ ফ্যাসলিটিজ প্রজেক্ট’ নামে একটি প্রকল্প চালু করছে। দেশের ১৬টি জেলার ৪৫টি উপজেলায় ৮ হাজার কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।

স্থানীয় মহলগুলোর অভিযোগ, সরকার যেখানে পাড়াকেন্দ্রের উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ করে এই ধারণা দেশব্যাপী সম্প্রসারণের চেষ্টা করছে, সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন ভূমিকা নিতেই গড়িমসি করে আসছে।

জানা গেছে, ২০২৩ সালে ৩০ জুন পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, মেয়াদ শেষে সরকারি ব্যয় ও দাতা সংস্থার সহায়তায় নির্মিত ৪ হাজার ৮০০ পাড়াকেন্দ্রের অবকাঠামো ও কেন্দ্রগুলোতে সরবরাহকৃত শতকোটি টাকার সম্পদের কী হবে? এ নিয়েও কিছু ভাবছে না প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।

চলতি বছরের ৩১ মে মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্পটি মেয়াদ শেষে কিভাবে চলবে তার প্রস্তাবনা ২০ জুনের মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারেনি পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। পরবর্তীতে ৩০ জুলাই পর্যন্ত প্রস্তাব প্রেরণের সময় বাড়ানো হলেও সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব প্রেরণ করতে পারেনি বলে নিশ্চিত হয়েছে এই প্রতিবেদক।

প্রকল্পটির স্থায়ীকরণ বিষয়ে কাজ করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে একজন পরামর্শক নিয়োগের কথা ডিপিপিতে উল্লেখ ছিল। কিন্তু উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাত কারণে পরামর্শক নিয়োগ থেকে বিরত থাকে। তাছাড়া একই বিষয়ে কাজ করার জন্য ইউনিসেফ একজন পরামর্শক নিয়োগ করলেও তিনি মাঝপথে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই পদত্যাগ করেন।

এ বিষয়ে ইউনিসেফ কর্তৃক নিয়োগকৃত পরামর্শক ড.সৈয়দ তারেকুজ্জামান মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো চায়নি তথা আন্তরিকতা ছিল না রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করতে। আমি কাজ করতে পারি নাই। বেতন নেবো কেন? তাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। আমার ক্ষোভ ছিল। এই প্রকল্পটি রাজস্বখাতে গেলে হাজার হাজার কর্মচারী ও গরীব পরিবার উপকার হতো।

এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘নতুনভাবে টেকসই সামাজিক সেবা প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হবে। প্রকল্পটি রাজস্বখাতে নেওয়ার সুযোগ নেই। প্রকল্পের ডিপিপিতে একজন কনসালটেন্ট পরামর্শক নিয়োগের প্রয়োজন ছিল না।’

একটি সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ বিষয়ে আলোচনার জন্য দাতা সংস্থা ইউনিসেফ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের কাছে চিঠি পাঠালেও কোনো সাড়া পায়নি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!