সিসিটিভি ফুটেজ জানাল ‘অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার’ যুবক তিনদিন ধরে ছিল ডিবিতেই

কলকাঠি নেড়েছে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা

আর দশটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মতো এটিও— ‘দিবাগত রাত ১.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন টাইগারপাস রেলওয়ে পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে একটি দেশীয় বন্দুক, একটি কার্তুজ, একটি ফোল্ডিং ছুরি ও একটি চাপাতিসহ মো. শোয়েবকে (৩০) গ্রেফতার করা হয়েছে।’

এটিও হতে পারতো আর দশটি ঘটনার মতোই। আর দশটি গণমাধ্যমের মতো চট্টগ্রাম প্রতিদিনেও যথারীতি প্রকাশিত হয়ে গেছে ‘টাইগারপাস থেকে অস্ত্রসহ ৩জন গ্রেপ্তার’। কিন্তু এরপরই চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এল ভিন্ন কাহিনী। একটি সিসিটিভি ফুটেজ চোখে আঙ্গুল দিয়ে জানিয়ে দিল পুরো ঘটনাটিই সাজানো। ২২ ডিসেম্বর টাইগারপাস রেলওয়ে পাহাড়ের যার কাছ থেকে ‘একটি দেশীয় বন্দুক, একটি কার্তুজ, একটি ফোল্ডিং ছুরি ও একটি চাপাতি’ পাওয়া গেল, সেই যুবককে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তারও তিনদিন আগে।

মুরাদপুর ১ নং রেলগেইটের ২০ ডিসেম্বর বিকেল পৌনে চারটার একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, সাদা পোশাকের একদল লোক একটি সাদা মাইক্রোবাসে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিচ্ছে এই যুবককে। সেই থেকে টানা তিন দিন শোয়েব নামের এই যুবক ছিলেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হেফাজতে, ডিবি কার্যালয়েই। এই তিনদিনের প্রতিদিনই তার স্বজনরা সেখানে গিয়ে দেখা করে এসেছেন রেজিস্টার খাতায় স্বাক্ষর করে। সোমবার হঠাৎ দেশীয় বন্দুক, কার্তুজ আর ফোল্ডিং ছুরির গল্পে শোয়েবের স্বজনরা হতবাক।

পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহযোগিতায় শোয়েবকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে কলকাঠি নেড়েছে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। এর মধ্যে এক নেতাকে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, যখন শোয়েবকে টেনেহিঁচড়ে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হচ্ছিল।

শোয়েবের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন, ডিবি কার্যালয়ে তিন দিন রাখার পর শোয়েবকে অপরিচিত অন্য আসামিদের সঙ্গে একটি অস্ত্র মামলায় সাজানো আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) পাঠানো একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘রোববার (২২ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত ১.৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন টাইগারপাস রেলওয়ে পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে একটি দেশীয় বন্দুক, একটি কার্তুজ, একটি ফোল্ডিং ছুরি ও একটি চাপাতিসহ জিকু চন্দ্র দাশ (২৬), মো. শোয়েব (৩০) ও মো. সাজ্জাত হোসেনকে (২৬) গ্রেফতার করা হয়েছে।’

সিসিটিভি ফুটেজ জানাল ‘অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার’ যুবক তিনদিন ধরে ছিল ডিবিতেই 1

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ২০ ডিসেম্বর বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে পাঁচলাইশ মডেল থানার মোহাম্মদপুর এলাকা সংলগ্ন মুরাদপুর ১ নং রেলগেইট থেকে ডিবি পুলিশের পরিদর্শক রুহুল আমিনের নেতৃত্বে শোয়েবকে আটক করে মাইক্রোবাসে তুলে নিচ্ছে ডিবির সদস্যরা। এর কিছুক্ষণ আগে একটি মোটরসাইকেলে চড়ে সেখানে আসেন সোহেল বড়ুয়া। তিনি চট্টগ্রামের এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের নেতা।

শোয়েবের পরিবারের সদস্যদের দাবি, সোহেল বড়ুয়ার সাথে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ডিবি পুলিশের যোগসাজশে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় শোয়েবের সাথে যে দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে ডিবির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের সাথে শোয়েব কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের কোন পরিচয় নেই।

তবে বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা সোহেল বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ে এসে বলেছেন, ‘শোয়েবের সাথে আমার কোন দ্বন্দ্ব নেই। কিছুদিন আগে যখন সে স্থানীয় কাউন্সিলর মোবারক আলীর অফিসে গুলি করে গ্রেফতার হয়েছে তখন আমি তার নাম শুনেছি। আর ওইদিন মুরাদপুরের ওখানে আমি গিয়েছিলাম আমার এক বন্ধুকে কিছু টাকা দিতে। সেখানে গিয়ে তাকে না পেয়ে আমি ওর মোবাইলে কল করেছিলাম। যেটা ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমার সাথে ডিবির সাথে কোন রকমের কোন যোগাযোগ হয়নি। আমি ছাত্রলীগের একজন সামান্য কর্মী। আমার সাথে দ্বন্দ্বের কারণে একজনকে ডিবির হাতে ফাঁসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই।’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে শোয়েবের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ২০ ডিসেম্বর থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিবি কার্যালয়ে ডিবি পুলিশের হেফাজতে ছিলেন শোয়েব। এই তিন দিনে ৩ দফায় ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে শোয়েবের সাথে সাক্ষাৎ করেন তারা। প্রতিবারই দর্শনার্থী রেজিস্টারে স্বাক্ষর করেই দেখা করেছেন তারা। অথচ সেই শোয়েবকে ২৩ ডিসেম্বর রাত দেড়টায় সিআরবিতে কথিত অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করার খবর অবাক করেছে তাদের।

পরিবারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০ ডিসেম্বর গ্রেপ্তারের পর ওইদিন রাত ১০টায় চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কার্যালয়ে শোয়েবের সঙ্গে দেখা করেন শোয়েবের ভাই নাহিদ। পরদিন ২১ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টায় ৪ জনকে নিয়ে শোয়েবের সঙ্গে আবার দেখা করেন আব্দুল হামিদ। সঙ্গে ছিলেন মোহাম্মদপুর এলাকার শোয়েবের প্রতিবেশী মামুনুর রশীদ, খোকন, ইকবাল ও আজম।। ২২ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় শোয়েবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার ভাই আব্দুল হামিদ। এদের প্রত্যেকেই চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, প্রতিবারই ডিবি কার্যালয়ে দর্শনার্থী রেজিস্টারে স্বাক্ষর করেই শোয়েবের সাথে দেখা করেছিলেন তারা। সাক্ষাতে ডিবির ইন্সপেক্টর রুহুল আমিন তিন দিনই শোয়েবকে ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানান তারা।

এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের (উত্তর) উপ কমিশনার মিজানুর রহমানের মোবাইলে কয়েকবার ফোন করা হলেও তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

সিএমপির অতিরিক্ত উপ কমিশনার (ডিবি উত্তর) মির্জা সায়েম মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি গত ২-৩ দিন ধরে বিপিএলের ডিউটি করছি। এখানে ব্যস্ত আছি। আপনারা ইন্সপেক্টর রুহুলের সাথে যোগাযোগ করুন’।

ডিবির ইন্সপেক্টর রুহুল আমিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এই লোকের বিরুদ্ধে অস্ত্র চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে চারটি মামলা রয়েছে। আপনি তার এলাকায় গিয়ে খবর নিলেই বুঝবেন সে কেমন মানুষ। খারাপ মানুষদের গ্রেফতার করেও শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না।’

আটকের সময় ও গ্রেফতার দেখানোর সময়ের ফারাক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অপরাধীদের ধরতে পুরো শহর দৌড়াতে হয় আমাদের। একটা আসামিকে এক জায়গা থেকে তাড়া করে আরেক জায়গায় ধরা হয়। এখন রিপোর্টে আমি কয়টা জায়গার বিষয়ে উল্লেখ করবো? তাছাড়া শোয়েবের পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্নভাবে তদবির করা হয়েছিল। আমি সেসব ফাঁদে পা না দেওয়ায় তারা এখন এসব অপপ্রচার করছে।’

শোয়েবের বিরুদ্ধে চারটি অস্ত্র ও চাঁদাবাজি মামলার বিষয়ে ডিবির ইন্সপেক্টর রুহুল আমিনের বক্তব্য প্রসঙ্গে শোয়েবের পরিবারের সদস্যরা ইন্সপেক্টর রুহুল আমিন মিথ্যাচার করছেন বলে দাবি করেছেন।

তারা বলেন, গত বছর কোরবানি ঈদের আগেরদিন পাঁচলাইশ থানা পুলিশ জহির এক ব্যক্তিকে একটি একনলা বন্দুকসহ গ্রেফতার করে। এর একদিন পর একই কায়দায় অস্ত্র মামলায় আসামি দেখিয়ে শোয়েবকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ বিষয়ে একটি অস্ত্র মামলা ও একটি ডাকাতি প্রস্তুতির মামলা দায়ের করা হয়। মূলত এ দুটি মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে শোয়েবকে।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!