সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের মামলার ৩ ‘সাক্ষী’ মূল ঘটনাই জানে না

সেনাকর্মকর্তা হত্যার ঘটনা ধামাচাপায় তৎপর পুলিশ

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় টেকনাফ পুলিশের মামলায় যে তিনজনকে ‘সাক্ষী’, তারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তো দূরের কথা, মূল ঘটনাই তারা জানেন না। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাসের নির্দেশে এদের প্রত্যেককে থানায় ডেকে এনে সাদা কাগজে সই নিয়ে ‘সাক্ষী’ বানানো হয়। থানার ভেতরে স্বাক্ষর নেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন ওসি প্রদীপ, লিয়াকতসহ আরও বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য। পরে মূল ঘটনা জেনে সাক্ষীরাই বিস্মিত হন।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা নিহতের ঘটনায় চলমান তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া ও প্রকৃত ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ— এমনটিই দাবি করছেন নিহত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের পরিবার ও তাদের স্বজনরা।

শুধু তাই নয়, ওইদিনের ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় যে মামলা করা হয়েছে সে মামলায় তিনজনকে ‘সাক্ষী’ বানিয়েছে পুলিশ। অথচ ওই সাক্ষীরা জানেন না প্রকৃত ঘটনার কিছুই।

জানা গেছে, সিনহার নিহতের ঘটনায় পুলিশ বাদি হয়ে যে মামলাটি করেছিলেন সেখানে সাক্ষী করা হয়েছে তিন ব্যক্তিকে। তারা হলেন টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া মারিশবুনিয়া এলাকার নাজির উদ্দিন প্রকাশ রাজুর পুত্র নুরুল আমিন (২২), আব্দুল গফুরের পুত্র হামিদ হোসেন (২৪) এবং জালাল আহমদের পুত্র মো. আইয়াছ উদ্দিন (৪০)।

কথিত এই তিন সাক্ষীর অন্যতম নুরুল আমিন বলেন, ‘সাবেক সেনাদস্য সিনহার মৃত্যুর ঘটনার বিষয়টি আমি চোখেও দেখিনি। কানেও শুনিনি। আমার সঙ্গে পুলিশের লোকজন আলাপ না করে সাদা কাগজে সই নিয়েছে। স্বাক্ষর নেওয়ার সময় খোদ উপস্থিত ছিলেন ওসি প্রদীপ, লিয়াকতসহ অন্যান্য পুলিশ অফিসাররা।’

কথিত অপর সাক্ষী মো. আইয়াছ উদ্দিন বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার পর আমাকে পুলিশ ফাঁড়িতে ডেকে নিয়ে যায় পুলিশের একটি টিম। সেখানে আমার সঙ্গে কোনো কথা বলার আগে ১০-১২টি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন পুলিশ কর্মকতার্রা। এখন শুনছি আমি নাকি নিহত সিনহার বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা মামলায় সাক্ষী হয়েছি। অথচ আমি এ ঘটনার কিছুই জানি না।’

তিনি বলেন, ‘সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া পুলিশ সদস্যদের দেখলে চিনতে পারবো।’

নিহত সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানের পরিবার ও তাদের স্বজন শুরু থেকে দাবি করে আসছিলেন, ভ্রমণবিষয়ক তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে কক্সবাজারের টেকনাফে গিয়েছিলেন মেজর সিনহা ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানে তারা ছিলেন হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্টে।

সিনহার পরিবার ও তার স্বজনদের মূল ঘটনার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু বক্তব্য মিলে যায় হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাষ্য।

ওই রিসোর্টের কর্মকর্তারা জানান, ঘটনার আগে মেজর (অব.) সিনহা ও তার সঙ্গীরা ভ্রমণবিষয়ক তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে তাদের রিসোর্টে অবস্থান করছিলেন। হিমছড়ি মেরিন ড্রাইভ এলাকাটির বিপরীত পাশে সাগর সংলগ্ন পাহাড়ের টিলা বিশিষ্ট জায়গাতে মনোরম দৃশ্য ধারণের শুটিং করেছিলো সিনহার টিম। সেখানে সিফাত ক্যামেরার পেছনে কাজ করতেন, শিপ্রা ভ্রমণ বিষয়ে উপস্থাপনার ভূমিকায় ছিলেন এবং সার্বিকভাবে তত্ত্বাবধান করতেন মেজর সিনহা সাহেব।

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজারের টেকনা‌ফ উপ‌জেলার বাহারছড়ায় মে‌রিন ড্রাইভ সড়কে পু‌লিশের গু‌লিতে নিহত হন সেনাবা‌হিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। তিনি যশোরের ১৩ বীর হেমায়েত সড়কের সেনানিবাস এলাকার মৃত এরশাদ খানের ছেলে। ৩৬ বছর বয়সী রাশেদ খান স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন তার কর্মকালে। তার বাবা প্রয়াত এরশাদ খান ছিলেন অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক উপসচিব।

ওই ঘটনার পর টেকনাফ থানার পু‌লিশ দাবি করে, ওই সেনা কর্মকর্তা তার ব্য‌ক্তিগত গা‌ড়িতে করে অপর একজন স‌ঙ্গীসহ টেকনাফ থেকে কক্সবাজার আস‌ছিলেন। ‌মে‌রিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া চেকপোস্টে পু‌লিশ গা‌ড়ি‌টি থা‌মিয়ে তল্লাশি করতে চাইলে সেনা কর্মকর্তা বাধা দেন। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে সেনা কর্মকর্তা তার কাছে থাকা ‘পিস্তল’ বের করলে পুলিশ গু‌লি চালায়। এতে সেনা কর্মকর্তা রাশেদ ‘গুরুতর আহত’ হন। আহত অবস্থায় তাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে ‌গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।

কক্সবাজার পু‌লিশ সুপার এ‌বিএম মাসুদ হোসেনও তখন দাবি করেছিলেন, সামলাপু‌রের লোকজন ওই গা‌ড়ির আরো‌হীদের ‘ডাকাত সন্দেহ করে’ পু‌লিশকে খবর দেয়। এই সময়ে পু‌লিশ চেকপোস্টে গা‌ড়ি‌টি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু গা‌ড়ির আরো‌হী একজন তার পিস্তল বের করে পু‌লিশকে গু‌লি করার চেষ্টা করে। আত্মরক্ষার্থে পু‌লিশও গু‌লি চালায়। এতে ওই ব্যক্তি মারা যায়।

পুলিশ সুপার আরও জানান, এই ঘটনায় দু‌টি মামলা হয়েছে। ২ জনকে আটক করা হয়েছে। পু‌লিশ পিস্তল‌টি জব্দ করেছে। এছাড়া গা‌ড়িতে তল্লাশি করে ৫০টি ইয়াবা, কিছু গাজা এবং দুটি বিদেশি মদের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে। নিহত মেজর (অব.) রা‌শেদ এক‌টি তথ্য চিত্রধারণের কাজে এক নারী ও অপর ৩ জন পুরুষ সঙ্গীসহ গত এক মাস ধরে হিমছ‌ড়ির এক‌টি রেস্টহাউজে অবস্থান কর‌ছিলেন।

টেকনাফ থানা পুলিশ ও কক্সবাজারের পুলিশ সুপারের এই দাবি নিয়ে তখনই সন্দেহ তৈরি হয় বিভিন্ন মহলে।

পুলিশের গুলিতে নিহত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস বুধবার (৫ আগস্ট) কক্সবাজারে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ওই ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন। আদালতের নির্দেশমতে গত ৫ আগস্ট ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি ও ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ২নং আসামি করে ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড হয়েছে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা। এই মামলার সূত্র ধরে চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয় বহুল বির্তকিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে। পরে জামিন না মঞ্জুর করা হয় ওসি প্রদীপসহ এই মামলার সাত আসামির।

মামলার এজাহারে নিহত সেনা কর্মকর্তার বোন শারমিন লিখেছেন, ‘বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলী টেকনাফ মডেল থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দেন। তার নির্দেশ পেয়ে লিয়াকত আলী বলেন, ‘ঠিক আছে স্যার, … শেষ কইরা দিতাছি।’ এরপরই মেজর (অব.) সিনহার শরীরের ওপরের দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি করেন লিয়াকত আলী। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান এবং নিজের জীবন বাঁচাতে ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করলে অন্য আসামিরা তাঁকে চেপে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। তখন সিনহাকে আরও এক রাউন্ড গুলি করা হয়। এরপর ঘটনাস্থলে প্রদীপ কুমার দাশ হাজির হন। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীরে ও মুখে কয়েকটি লাথি মেরে মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হন। তিনি মৃতদেহের মুখ বিকৃত করার চেষ্টা করেন।’

এই ঘটনায় ওসি প্রদীপ কুমার দাসসহ আত্মসমর্পণ করা ৭ জনকেই রিমান্ডে নিয়েছে র্যাব। বাকি দুজন পলাতক রয়েছেন। এদিকে শুক্রবার (৭ আগস্ট) সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও মেজর সিনহাকে গুলি করা পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ সাত পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়া অন্য পুলিশ সদস্যরা হলেন টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাফানুর করিম, উপপরিদর্শক নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল কামাল হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন এবং সহকারী উপপরিদর্শক লিটন মিয়া।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!