রোহিঙ্গাদের কাছে সংখ্যালঘু উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয়রা

রোহিঙ্গা সংকটের দুই বছর

মানবিক খাতিরে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফবাসীর মাঝে করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। অনেকেই হারিয়েছে বাস্তুভিটার অংশ ও চাষাবাদের জমি।

জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে নতুন করে রোহিঙ্গা ঢল শুরুর পর কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বাসিন্দারাই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। মানবতার খাতিরে যতটুকু সম্বল ছিল তা দিয়েই অসহায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও আশ্রয় দিয়েছিল। রোববার (২৫ আগস্ট) সেই ঘটনার দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে। ২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার ঢল নামে। রোহিঙ্গার সেই ঢল যে এত বড় ও দীর্ঘমেয়াদি হবে সেটা ভাবতে পারেনি স্থানীয় বাসিন্দারা। সেদিন যারা মানবিকতার অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল আজ তারাই চরম দুর্দশা ও ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। অনেকের ফসলি জমি, বাড়ির উঠান পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। কবে নাগাদ রোহিঙ্গারা ফিরবে বা আদৌ তারা ফিরবে কি না, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন তারা।

জানা গেছে, নতুন ও পুরনো মিলিয়ে মিয়ানমারের ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস এখন উখিয়া ও টেকনাফে। সীমান্তবর্তী এই দুই উপজেলার ২৮টি পাহাড়ের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরের দুই লাখেরও বেশি ঝুঁপড়িতে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। এর প্রভাব পড়েছে পর্যটন জেলা কক্সবাজারেই। ওই অঞ্চলের উন্নয়ন হুমকিতে পড়ার পাশাপাশি দীর্ঘ মেয়াদে নিরাপত্তা ঝুঁকিও সৃষ্টি হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে দুই উপজেলার বাসিন্দারা।
গত জুলাই মাসে বেসরকারি নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে আশ্রয়দাতা সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য ৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় আড়াই হাজার পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। এর বাইরে আরও এক হাজার ৩০০ পরিবার ঝুঁকিতে পড়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে সেখানে ৪৬৪ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের বনজ সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, উখিয়া ও টেকনাফের সবুজ পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্য ঘর তৈরির জন্য কেটে ফেলা হয়েছে পাহাড়ি ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালা। এক সময়ের সবুজ পাহাড় এখন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে সেখানে পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। পাহাড়ে রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপন করতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল ও বিচরণক্ষেত্রও বিনষ্ট হয়েছে। এছাড়া প্রতিমাসে রোহিঙ্গাদের রান্নাবান্নার কাজে ছয় হাজার ৮০০ টন জ্বালানি কাঠ প্রয়োজন। রোহিঙ্গারা স্থানীয় পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকেই ওই কাঠ সংগ্রহ করে। গত জুলাই মাসে কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, বালুখালী ঢালা, ময়নারঘোনা, থাইংখালী তাজনিমার খোলা, হাকিমপাড়া, জামতলি বাঘঘোনা, শফিউল্লাহ কাটা এবং টেকনাফের চাকমারকুল, উনচিপ্রাং, লেদা, মৌচনী, জাদিমুরা ও কেরানতলী এলাকাসহ বন বিভাগের গেজেটভুক্ত প্রায় ছয় হাজার ১৬০ একর বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে।
বনভূমিতে রোহিঙ্গাদের এভাবে বসতি স্থাপনের কারণে টাকার হিসাবে সৃজিত এবং প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি হয়েছে ৪৫৬ কোটি আট লাখ টাকা। একইভাবে জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৪০৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে বনজ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির পরিমাণ অন্তত এক হাজার ৮৬৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। শুধু বনভূমি বা জীববৈচিত্র্যই নয়, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা বসতি মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কেও। ৭৯ কিলোমিটারের এই সড়কে স্থানীয় বাসিন্দাদের বহন করা গাড়ি এবং টেকনাফ স্থলবন্দরের নিয়মিত পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ও অন্যান্য মালামাল বহনকারী শত শত ভারী যানবাহন যাতায়াত করছে।
এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার অন্তত ২৫০ গাড়িও এ সড়কে চলাচল করে। তাই সড়কে যানজট যেমন বাড়ছে, তেমনি সড়ক ভেঙে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়ে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

Rohinga-02

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও পালংখালী ইউপির চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের হিংস্রতায় উখিয়া-টেকনাফের করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। যেভাবে রোহিঙ্গারা অনৈতিক আইনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হচ্ছে, তাতে আমরা স্থানীয়রা ভীতসন্ত্রস্ত পরিস্থিতির মধ্যে আছি।’

উখিয়ার কলেজ ছাত্র আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘এ সড়ক দিয়ে কেউ আর এখন যাতায়াত করতে চায় না। সড়কে যাতায়াত করতে এখন আগের দ্বিগুণ সময় ব্যয় হয়। মূলত রোহিঙ্গা ঢল নামার পর থেকে এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’ আমরা উখিয়া-টেকনাফবাসী রোহিঙ্গা মুক্ত আবাস চাই।

কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, ‘এটা সত্য যে রোহিঙ্গাদের কারণে ওই সড়কটি এখন ব্যস্ততম সড়কে পরিণত হয়েছে। অতিরিক্তসংখ্যক যানবাহন এখন এই সড়কে চলাচল করছে। বর্ষার কারণে কাজে কিছুটা সমস্যা হয়েছে, তবু আমরা জরুরি সংস্কারকাজগুলো অব্যাহত রেখেছি। বর্ষা শেষ হলে সড়কের উন্নয়নকাজ কম সময়ে শেষ হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও প্রায় সার্বক্ষণিক নজরদারি ও পথেঘাটে তল্লাশির শিকার হতে হচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে আশ্রয়শিবির ছেড়ে না পালাতে পারে সে জন্য টেকনাফ-কক্সবাজার প্রধান সড়ক ও মেরিন ড্রাইভ সড়কে অন্তত সাতটি তল্লাশি চৌকি স্থাপন করেছে নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেগুলোতে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে হয়।
রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় শ্রমবাজারেও বড় প্রভাব পড়েছে। রোহিঙ্গারা স্বল্প মজুরিতে শ্রম দিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাজের সুযোগ সংকুচিত করছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও নিবন্ধন কার্যক্রমের কারণেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। যেন রোহিঙ্গা আক্রান্তের পরিধি দিন-দিন বাড়তেই থাকছে। এসব থেকে পরিত্রাণ চাই। কবে নাগাদ রোহিঙ্গা মুক্ত বসবাস নিশ্চিত হবে তা নিয়ে শংকায় স্থানীয়রা।

এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!