রাজনীতি ছাড়ার শর্ত মেনেও হেফাজত নেতারা জেল থেকে ছাড়া পেতে মরিয়া

নোমান ফয়েজীর ভাইয়ের ‘অঙ্গীকারনামা’ গেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে

মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকা হেফাজতে ইসলামের নেতারা। মামলার জালে পড়ে কারাগারে যাওয়া হেফাজত নেতাকর্মীদের বেশিরভাগই চট্টগ্রামের। সংগঠনটির ঢাকাকেন্দ্রিক নেতাদেরও অনেকে চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার বিভিন্ন মামলার আসামি। ভবিষ্যতে আর রাজনীতি নয়— এমন অঙ্গীকার করে এখন নেতাকর্মীদের মুক্তিই মূল লক্ষ্য হয়ে উঠেছে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের। হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব সরকারের সঙ্গে সহাবস্থান গড়ে যেকোনো মূল্যে কারাবন্দি নেতাদের মুক্তি চান। সেজন্য নিজেদের শুধুই ধর্মীয় আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং রাজনীতি না করার শর্ত মানতেও রাজি হেফাজত। এমনকি সামাজিক মাধ্যমে সরকারবিরোধী বক্তব্য-বিবৃতি থেকেও দূরে থাকবেন নেতারা।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে পাঁচ সদস্যের আইনি কমিটি গঠন ছাড়াও সরকারের শীর্ষ মহলে যোগাযোগ করে তদবির করা হচ্ছে। আবার কারাবন্দি অনেক নেতার পরিবার নিজেদের উদ্যোগে সরকারের বিভিন্ন মহলে ধর্না দিয়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হেফাজতের ৪৩০ জন নেতাকর্মী মুক্তি পেয়েছেন বলে জানা গেছে। এর বাইরে আরও প্রায় ৪৫০ নেতাকর্মী এখনও কারাগারে আছেন।

গত বছরের ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েন হেফাজত নেতাকর্মীরা। সহিংসতার মামলায় হেফাজতের ৩০ নেতাসহ সারা দেশ থেকে ১ হাজার ২৩০ জনেরও বেশি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। আটকদের কারামুক্ত করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন মহলে নিবিড় যোগাযোগ রেখে যাচ্ছেন হেফাজত নেতারা।

কারাবন্দি আলেমদের আইনি সহায়তা ও মুক্তি ত্বরান্বিত করতে পাঁচ সদস্যের সাবকমিটিও করেছে হেফাজত। কমিটিতে রয়েছেন হেফাজতের সিনিয়র নেতা অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান চৌধুরী, হেফাজতের নায়েবে আমির ও হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইয়াহইয়া, আল্লামা সাজিদুর রহমান, মাওলানা মীর ইদ্রিস নদভী, মাওলানা মুহিউদ্দীন রাব্বানী।

নোমান ফয়েজীর মুক্তি চেয়ে ভাইয়ের ধরনা

সর্বশেষ চট্টগ্রাম কারাগারে থাকা হেফাজত নেতা জাকারিয়া নোমান ফয়েজীর মুক্তির জন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। গত জানুয়ারিতে তার ছোটভাই মুফতি মাহমুদ হাসান ফয়েজীর করা আবেদনে ‘যথারীতি ভবিষ্যতে আর রাজনীতি নয়’— এমন অঙ্গীকারই করা হয়েছে। সেই আবেদনে সুপারিশ করেছেন হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক মুফতি জসিম উদ্দীন।

মাওলানা ফয়েজী হেফাজতে ইসলামের বিলুপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া হামিয়ুচ্ছুন্নাহ মেখল মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দেওয়া আবেদনে জাকারিয়া নোমান ফয়েজীর ভাই অঙ্গীকার করে লিখেছেন— ‘আমি এ মর্মে নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, আমার পিতৃতুল্য বড় ভাই মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী মাদ্রাসায় পাঠদান ও সামাজিক কাজে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবেন। মসজিদ-মাদ্রাসার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখবেন। কোনও রাজনৈতিক দল ও কোনো ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে আগে ছিল না, আগামীতেও থাকবে না ইনশাল্লাহ।’

হেফাজতের সাবেক প্রচার সম্পাদক হাটহাজারীর মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজীর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১৩টি। এর মধ্যে শুধু একটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন।

গত বছরের ৪ মে কক্সবাজারের চকরিয়া থেকে জাকারিয়া নোমান ফয়েজীকে গ্রেপ্তার করে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট। গত বছরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে হেফাজতে ইসলামের সহিংস তাণ্ডবের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

গ্রেপ্তারের দুদিন পর ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মডেল থানায় হেফাজত নেতা জাকারিয়া নোমান ফয়েজীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন এক নারী। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে না করেও প্রতারণা করে বিভিন্ন সময়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযুক্ত করেন।

ওই মামলার বিবরণে বলা হয়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকের মাধ্যমে হেফাজত নেতা ফয়েজীর সঙ্গে ওই নারীর পরিচয় হয়। মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ চ‍্যাটিংয়ের মাধ্যমে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলেন। পরে বিয়ের করার কথা বলে ওই নারীকে হাটহাজারীতে আসতে বলেন। সে অনুযায়ী ওই নারী হাটহাজারী এলে ওই বছরের নভেম্বরে পৌরসভার ফটিকা গ্রামে কনক বিল্ডিংয়ের নিচ তলায় বাসা ভাড়া করে দেন হেফাজত নেতা ফয়েজী। প্রায় এক বছর ধরে ভাড়া বাসায় অবস্থানকালে বিভিন্ন সময় তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেন। পরবর্তীতে ওই নারী হাটহাজারী থেকে চট্টগ্রাম শহরে তার খালার বাসায় চলে আসেন। এরপরও বিয়ের প্রলোভন দিয়ে সুকৌশলে বিভিন্ন বাসা ও হোটেলে নিয়ে গিয়ে ফয়েজী তাকে ধর্ষণ করেন। অবশেষে তার প্রতারণা বুঝতে পেরে ওই নারী নিজে বাদী হয়ে হাটহাজারী মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন।

ধর্ষণ মামলাটি দায়েরের এক সপ্তাহের মাথায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ধর্ষণের অভিযোগ ‘স্বীকার’ করে দায়ের হওয়া মামলায় চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জয়ন্তী রাণী রায়ের আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন হেফাজত নেতা জাকারিয়া নোমান ফয়জী। পুলিশ জানায়, সেই জবানবন্দিতে ফয়জী অভিযোগকারী নারীর সঙ্গে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক এবং তাকে বিভিন্ন সময় ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছেন।

এদিকে মুক্তি চেয়ে গত মার্চে একইভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরে আবেদন করেছেন হেফাজতের ঢাকা মহানগর বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি জুনায়েদ আল হাবীবের দুই স্ত্রী। কাশিমপুর কারাগারে থাকা ২০ মামলার আসামি এই মাওলানার মুক্তি চেয়ে আবেদনে অঙ্গীকার করা হয়, ‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমাদের স্বামী ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কোনোধরনের বক্তব্য প্রদান করবেন না এবং ব্যক্তি ও কর্মজীবনে বিশেষ করে ওয়াজ মাহফিলে ধর্মীয় বিষয়ের মধ্যে বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখবেন। বাংলাদেশ সরকার এসব বিষয়ে যে নির্দেশনা দিবেন তিনি সেভাবেই চলবেন।’

মামলায় হাটহাজারী ফ্যাক্টর

হেফাজতে ইসলামের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের নামে আছে মোট ২৮টি মামলা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতেই আছে আটটি মামলা। মামুনুল হকের পরিবারও সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছে। হেফাজতের ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীবের নামে মামলা আছে ১৯টি। এর মধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে আছে আটটি মামলা।

সংগঠনটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক চট্টগ্রামের মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদীর নামে মামলা আছে দুই ডজন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে মতিঝিল থানায় ১টি, শাহবাগ থানায় ১টি, রমনা থানায় ১টি ও পল্টন থানায় ৮টি মামলা এবং ২০১১ সালে পল্টন থানায় ৩টি ও হাটহাজারী থানায় ১০টি মামলা।

চট্টগ্রামের হেফাজত নেতা মুফতি হারুন ইজহারের নামে মামলা আছে ১৩টি। হাটহাজারীর নাছির উদ্দীন মুনীরের নামে আছে ডজনখানেক মামলা। হেফাজতের প্রয়াত আমির জুনাইদ বাবুনগরীর প্রেস সেক্রেটারি এনামুল হাসান ফারুকীর নামে মামলা আছে ১১টি। চট্টগ্রামের মিফতাহ উদ্দীন নাবিহ সাআদের নামে ৬টি মামলা।

হেফাজতের রোকন উদ্দীনের নামে চট্টগ্রামে মামলা রয়েছে আটটি। কাজী মো. রাজীব আহাম্মেদ ওরফে শফিউল্লাহ নামে চট্টগ্রামে মামলা রয়েছে ছয়টি। এ ছাড়া আরও অন্তত ২০ জন নেতার নামে বিভিন্ন মামলা রয়েছে।

‘আগে যা হয়েছে তা ভুলে যান’

গত ৯ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দী নেতাকর্মীদের মুক্তি চেয়ে কওমি মাদরাসাভিত্তিক দলটির মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করেন। ওই বৈঠকে গ্রেপ্তার নেতাকর্মীদের মুক্তি চায় হেফাজতে ইসলাম। এ সময় হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালের সব মামলা প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়। ওই বৈঠকে চট্টগ্রাম থেকে হেফাজতের নায়েবে আমির ও হাটহাজারী মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা ইয়াহ্ইয়া এবং সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা মীর ইদরীস নদভীও উপস্থিত ছিলেন।

সেই বৈঠকে হেফাজতের এক নেতা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা দ্বীন ইসলাম, ঈমান-আকিদা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই। হেফাজত থেকে আর কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত আসবে না। সংগঠনের শূরা কমিটি সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। সংগঠনে আগে যা হয়েছে তা ভুলে যান। আগের কমিটিতে অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ মুরব্বি ছিলেন। তাদের নাম ভাঙিয়ে কেউ কেউ সংগঠনের কর্মীদের উসকে দিয়েছেন। এতে অনেক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়েছে।’

এ সময় বৈঠকে উপস্থিত পুলিশের একজন কর্মকর্তা হেফাজত নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের দাবিতে একটা আপত্তি আছে। আটকরা মুক্তি পেয়ে যদি ফের উগ্র আচরণ করে…? এর দায় কে নেবে?

জবাবে হেফাজতের নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান বলেন, ‘আগের মতো উগ্র হতে পারবে না। তাদের নামে মামলা তো থাকবেই। আপাতত জামিন দিন। ছাড়া পেয়ে উগ্র হলে আবারও ধরতে পারবেন। আর আমাদের জিম্মায় মুক্তি দিলে কেউ খারাপ কর্মকাণ্ডে জড়াবে না ইনশাল্লাহ।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!