বেতন বাকি, গরিবের ছেলেগুলো ফলাফল পেল না বার্ষিকের

‘বেতন প্রদানসাপেক্ষে ফলাফল প্রকাশ করা হইবে’

‘এই মুনতাসিইন্না তোর রোল হত অইয়্যে? আত্তুন পাঁচ অইয়্যে। রফিকের ১২, তোর হত?’— চুপ করে নোটিশ বোর্ডের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো মুনতাসিব রহমান (ছদ্মনাম)। পাশে থাকা আরেক বন্ধু বলছে— ‘ইতে বেক টিয়া (বেতন) ন দে, ইতাল্লাই ইতের রেজাল্ট বান্ধি রাইখ্যে স্যারে। টিয়া দিলে রেজাল্ট দিবো। তোর তুন টিয়া লাগিবো, বেতন দেন পড়িবো আঙ্কেলেরে ন কস তুই?’

মুনতাসিব বন্ধুদের কোনো কথার জবাব না দিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করে বাসার দিকে। মুনতাসিবের বাবার হঠাৎ চাকরি চলে যাওয়ায় কয়েক মাস বেকার ছিল। চাকরি না পেয়ে সংসার চালাতে অনেকটা বাধ্য হয়েই রিকশা চালানো শুরু করেন মোহাম্মদ। চার ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হয় রিকশাচালক বাবা মোহাম্মদকে।

বার্ষিক পরীক্ষার আগে সময়মতো বকেয়া বেতন পরিশোধ করার সুযোগ হয়নি হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র মুনতাসিবের। পরে দিয়ে দিবে বলে সময় চেয়ে বার্ষিক পরীক্ষা দিলেও শেষ পর্যন্ত ফলাফল নেই নোটিশে। কেবল বকেয়া বেতনের কারণে নোটিশ বোর্ডে নাম না কিংবা রোল কোনোটাই নেই। আর না থাকায় মুনতাসিব বুঝতে পারছে না সে পাস নাকি ফেল। নতুন শ্রেণিতে প্রমোশন হয়েছে কি না তাও বোঝার উপায় নেই বোর্ড দেখে। পরে আরেক নোটিশ বোর্ড দেখে বুঝতে পারলো বেতন বকেয়া থাকায় ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে। নোটিশে আরও উল্লেখ করা আছে, ‘প্রমোশন ক্লাসে ভর্তি হতে বলা হচ্ছে। যাদের বেতন বকেয়া আছে তাদের ফলাফল স্থগিত করা হইলো। বেতন প্রদানসাপেক্ষে ফলাফল প্রকাশ করা হইবে।’

শুধু যে মুনতাসিবের ফলাফল স্থগিত তা কিন্তু নয়। মুনতাসিবের মতন যাদের বেতন বকেয়া রয়েছে তাদের সকলেরই ফলাফল স্থগিত। নোটিশে দেখা যায়, নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ এক শিক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত। সে মেধাতালিকায় দ্বাদশ (১২) তম হয়েছে। বর্তমান রোলের পাশে নাম কিংবা পূর্বের শ্রেণির রোল নেই আর এতে সহজে অনুমেয় নয় কে হয়েছে ১২ তম। অন্যদিকে একইভাবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ আরেক শিক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত। সেও একইভাবে মেধাতালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। এভাবে আরও অনেকের ফলাফল স্থগিত যাদের কেউ কেউ কয়েক বিষয়ে অকৃতকার্যও আছে। এদিকে যা‌দের ফলাফল স্থ‌গিত করা হ‌য়ে‌ছে এদের ম‌ধ্যে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা ব‌কেয়া ছিল এমনও অনেকে আছে।

জানা গেছে, বেতন ব‌কেয়া হ‌লে ফলাফল স্থ‌গিত করার বিষ‌য়ে মন্ত্রণাল‌য়ের কো‌নো ধর‌নের নি‌র্দেশনা নাই। কিন্তু ফরহাদাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের ফলাফল প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক অভিভাবক। স্কুলটি চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নে অবস্থিত।

শামসুন্নাহার নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘স্কুল কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাচারিতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে। বেতন ব‌কেয়া হ‌লে ফলাফল কখ‌নো স্থ‌গিত থ‌াক‌তে পা‌রে না। এতে শিক্ষার্থী‌দের মন খারাপ হওয়‌াটাই স্বাভা‌বিক। অভিভাব‌কের দা‌রিদ্র্যতা তে‌া তার অপরাধ না। আর বেতন বকেয়া থাকলে পরীক্ষার আগেই গার্জিয়ান ডেকে জানানো উচিত। বছর শেষে এভাবে তার মনের ওপর চাপ দেয়ার মানে কী? তারা শিক্ষক হয়েও কি বোঝে না এমন করলে বাচ্চাদের মনোভাব কেমন হবে! এখন যা‌দের ফলাফল স্থ‌গিত করা হ‌য়ে‌ছে, তারা মান‌সিকভা‌বে মুষ‌ড়ে প‌ড়ে‌ছে।’

ফলাফল স্থগিত রাখার প্রসঙ্গে ফরহাদাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবুল আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনি কোথায় দেখছেন? এটা আমাদের মাধ্যমিক বেসরকারি স্কুল, এমপিওভুক্ত। এখানে অনেক ছেলে মেয়ে বাড়ি থেকে টাকা এনে খেয়ে ফেলে। স্কুলের বেতন দেয় না এজন্য। এখন কি গার্জিয়ান টাকা দিল না ছেলে খেয়ে ফেলল এটা তো বুঝতে পারি না। কিন্তু পরীক্ষা তো আমরা নিয়ে ফেলছি। এখন একটু পরীক্ষা করে দেখি ছেলে কি আসলেই টাকা খেয়ে ফেলছে, না গার্জিয়ান দেয় নাই। যাদের বেতন বাকি থাকে তাদের ফলাফল রেখে দেখি। গার্জিয়ান আসলে আবার ছেড়ে দেই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা তাদের বইও দিয়ে দিছি। এগুলো (স্থগিত) রাখি অনেক ছেলে বাড়ি থেকে টাকা খেয়ে ফেলে, এগুলো তো বুঝতে পারি না আমরা। এখন দিতে না পারলে আসে। প্রতি বছর থাকে। এ বছরেও পেয়েছি। যাদের গার্জিয়ান আসে তাদের ছেড়ে দিয়েছি।’

তবে এ প্রসঙ্গে ভিন্নমত বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ক‌মি‌টির সভাপ‌তি অধ্য‌াপক মঈনুদ্দীনের। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্থগিত বলতে যাদের টাকা-পয়সা বাকি আছে সে টাকাগুলো আদায় করার জন্য। পয়সাগুলো দিলে তাদের নাম উঠে যাবে বা অনেকে ফেলও করতে পারে। এগুলোকে স্থগিত বলা যায় না, এগুলো স্থগিত না। এগুলো তো দিতে হবে। স্কুল তো চালাতে হবে। আমরা তো নিজেদের পকেট থেকে টাকা দিচ্ছি। অভিভাবকরা অভিযোগ করলে তো হবে না। অভিযোগ কেন করবে?

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কে বলছে (অভিযোগ) আমাকে নামটা বলেন? কি জন্য করছে আপনারা ইনকোয়ারি করেন। এখানে দুই নাম্বারির কোনো কাম নাই।’

একই প্রসঙ্গে হাটহাজারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বছর শেষ, সব বাচ্চারা ফলাফল পাবে। এই আগ্রহের জায়গায় ধাক্কা খায় এটাই স্বাভাবিক। বিষয়টা আসলে আপনার কাছে জানলাম। আমার জানা ছিল না। এখন রাত হয়ে গেল কালকে আমি দেখবো কী করা যায়। এটা আসলে উচিত ছিল অভিভাবককে ডেকে তাদের জানানো। আর বছর শেষে ফলাফল না দেওয়ার প্রবণতা খুব দুঃখজনক আমার দৃষ্টিকোণ থেকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ প্রধান শিক্ষক চাইলে আলোচনা করতে পারতেন আমার সাথে। স্কুলের একটা বদনা চুরি হলেও তারা ইউএনওকে জানায়। এক্ষেত্রে কেন জানায়নি তা জানি না। তাহলে সমাধান বের করা যেত। তাছাড়া বছর শেষে ফলাফল পাওয়াটা আনন্দের ব্যাপার। আমি যদি আরো আগে জানতে পারতাম ফলাফল দেয়ার ব্যাপারে বিকল্প কিছু বের করতে পারতাম।’

বেতন বকেয়া থাকায় ফল স্থগিত রাখার নির্দেশনা প্রসঙ্গে শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল আলীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বেতন বকেয়া থাকলে রেজাল্ট আটকানোর সুযোগ নাই। অন্য সিস্টেমে তো করা যায়। তাছাড়া পরীক্ষা নেয়ার আগেই তো সব হিসাব নিকাশ করে ফেলে। যাদের বকেয়া আছে তাদের অভিভাবককে জানায়। যাতে তারা পরিশোধ করে ফেলে। ফলাফল স্থগিত করার নিয়ম কেউ নেই। যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’

এ প্রসঙ্গে সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন শিক্ষক সমাজ মানবতার জায়গায় আছে কিনা সন্দেহ। আমরা যদি বাচ্চাদের ফলাফল আটকে রেখে টাকা আদায়ের জন্য জিম্মি করি তাহলে আমি শিক্ষক হলাম কী করে? আমি বলবো এদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।’

এ প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আবু হাসান সিদ্দিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথম কথা হলো বিধান নেই ফলাফল স্থগিত রাখার। বাস্তবে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অনেকেই বেতনের ওপর নির্ভরশীল। অনেক প্রধান শিক্ষকের ভাষ্যমতে, বকেয়া রেখে ফলাফল দিয়ে দিলে টাকাগুলো তারা আর পায় না। এক্ষেত্রে পরীক্ষার আগে অভিভাবককে জানানো উচিত। মাত্র ২০০-৩০০ টাকার জন্য ফলাফল স্থগিত করা উচিত হয়নি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!