বিটিভিতে দুই মন্ত্রীর ২ কোটি টাকার ‘কথা’ ভোটের ১ মাসেই

খবরের অর্ধেকই ছিল দুজনের জন্য বরাদ্দ

রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সংস্থা বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) রাত ৮টার খবরে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এক মাসে মোট ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড বা ৮ ঘন্টা ২৩ সেকেন্ড ‘খবর’ প্রচার করা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের মোট আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বরাদ্দ সময়ের মূল্যমান ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক মাসে ১ কোটি ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকার কথা বলেছেন। অন্যদিকে একই সময়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হাছান মাহমুদের জন্য বরাদ্দ সময়ের মূল্যমান ছিল ৯৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। বিটিভির খবরের ৬৭ ভাগই এই তিনজনের জন্য বরাদ্দ ছিল। এর বাইরে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের প্রাধান্য দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণার খবরের জন্য বরাদ্দ ছিল আরও ২০ ভাগ সময়।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে সম্প্রতি এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন-প্রক্রিয়া কতোটুকু অবাধ ও স্বচ্ছ, সকলের জন্য নিরপেক্ষ ও সম-প্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে—সেসব ট্র্যাকিং করা ছিল এই গবেষণার উদ্দেশ্য। এজন্য দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি নির্বাচনী আসন নির্বাচন করা হয়।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন বিষয়ে বিটিভির রাত ৮টার খবরে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে মোট ১২ দিনে ১২২ মিনিট ২৭ সেকেন্ড বা ২ ঘন্টা এবং নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে ৩৭১ মিনিট বা ৬ ঘণ্টা ১১ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। এভাবে সবমিলিয়ে মোট সময় ব্যয় হয়েছে ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড বা ৮ ঘন্টা ২৩ সেকেন্ড। বিটিভির ‘পিক টাইম’ সংবাদের মাঝে প্রচারিত ‘স্পট বিজ্ঞাপন’ ক্যাটাগরির প্রতি ১০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের মোট আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা।

এতে দেখা গেছে, নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে ১২ দিনে বিটিভির রাত ৮টার খবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা ও ভিডিওচিত্র প্রচারিত হয়েছে ১৭ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে তার কথা ও ভিডিওচিত্র প্রচারিত হয়েছে ৮৯ মিনিট ২৫ সেকেন্ড। সবমিলিয়ে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট এক মাসে বিটিভির রাত আটটার খবরে তাকে নিয়ে ব্যয় হয়েছে ১০৭ মিনিট ২০ সেকেন্ড। বিটিভির বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৯৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

অন্যদিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথা ও ভিডিওচিত্র নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে মোট ১২ দিনে প্রচারিত হয়েছে ৫০ মিনিট ১৬ সেকেন্ড। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে তার কথা ও ভিডিওচিত্র প্রচারিত হয়েছে ৬৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড। সবমিলিয়ে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট এক মাসে বিটিভির রাত আটটার খবরে তাকে নিয়ে ব্যয় হয়েছে ১১৫ মিনিট ৫১ সেকেন্ড। বিটিভির বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা।

এদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে ১২ দিনে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হাছান মাহমুদের কথা ও ভিডিওচিত্র প্রচারিত হয়েছে ৪৩ মিনিট ১৪ সেকেন্ড। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে তার কথা ও ভিডিওচিত্র প্রচারিত হয়েছে ৬৩ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড। সবমিলিয়ে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট এক মাসে বিটিভির রাত আটটার খবরে তাকে নিয়ে ব্যয় হয়েছে ১০৭ মিনিট ১০ সেকেন্ড— যা প্রধানমন্ত্রীর জন্য ব্যয় করা সময়ের মাত্র ১০ সেকেন্ড কম। বিটিভির বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৯৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড অবশ্য নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে প্রচারিত হয়েছে মাত্র ৯ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটি বিটিভির খবরে ছিল ৩৩ মিনিট ৫১ সেকেন্ড। সবমিলিয়ে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট এক মাসে বিটিভিতে মোট ৪৩ মিনিট ৩৯ সেকেন্ড নির্বাচন কমিশনের কর্মকাণ্ড প্রচারিত হয়েছে। বিটিভির বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৩৯ লাখ ২৮ হাজার ৫০০ টাকা।

বিটিভির রাত ৮টার খবরে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে নির্বাচনী প্রচারণা সম্পর্কিত ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য প্রচার হয়েছে মাত্র ৪ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড। অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে বিটিভির খবরে একই ধরনের প্রচারণায় সময় ব্যয় হয়েছে ৯৫ মিনিট ২০ সেকেন্ড। সবমিলিয়ে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট এক মাসে বিটিভিতে মোট ৯৯ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড নির্বাচনী প্রচারণা সম্পর্কিত ফুটেজ ও অন্যান্য তথ্য প্রচারিত হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণা হলেও সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই মূলত প্রাধান্য পেয়েছেন। আর বিটিভির বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী ওই সময়টার আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৮৯ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকা।

নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে ১২ দিনে বিটিভির রাত ৮টার খবরে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব দল মিলে সময় পেয়েছে মাত্র ১ মিনিট ১৬ মিনিট ২২ সেকেন্ড। যদিও নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে দলগুলো ১৭ মিনিট ২২ সেকেন্ড সময় পেয়েছে। বিটিভির বিজ্ঞাপনের মূল্যহার অনুযায়ী ওই সময়টার আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ১৫ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।

এভাবে ২০২৩ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নির্বাচন বিষয়ে বিটিভির রাত ৮টার খবরে নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়ের আগে মোট ১২ দিনে ১২২ মিনিট ২৭ সেকেন্ড বা ২ ঘন্টা এবং নির্বাচনী প্রচারণার অনুমোদিত সময়কালে মোট ১৮ দিনে ৩৭১ মিনিট বা ৬ ঘণ্টা ১১ মিনিট সময় ব্যয় হয়েছে। এভাবে সবমিলিয়ে মোট সময় ব্যয় হয়েছে ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড বা ৮ ঘন্টা ২৩ সেকেন্ড। বিটিভির ‘পিক টাইম’ সংবাদের মাঝে প্রচারিত ‘স্পট বিজ্ঞাপন’ ক্যাটাগরির প্রতি ১০ সেকেন্ডের বিজ্ঞাপন মূল্যহার অনুযায়ী এই সময়ের মোট আর্থিক মূল্য হিসাব করা হয়েছে ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা।

টিআইবির গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিকে একচেটিয়া ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রচারণা ও সভা-সমাবেশের খবর প্রচার করা হয়েছে। নির্বাচনে অনুমোদিত প্রচারণার সময় সীমার মধ্যে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম সংক্রান্ত খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা এবং কমিশনের সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার সক্ষমতা সংক্রান্ত খবর প্রচার ছিল উল্লেখযোগ্য।’

টিআইবির গবেষণায় বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলো নিয়ে মন্তব্যে বলা হয়েছে, নির্বাচনের আগে ও পরে এই সংবাদ মাধ্যমগুলোও সার্বিকভাবে ক্ষমতাসীন দলের সহায়ক অবস্থান গ্রহণ করেছে।

এতে বলা হয়, ‘বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে হরতাল-অবরোধ-অগ্নিকান্ড ও নির্বাচন বর্জনের খবরসহ বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এই বিষয়ক সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্য অধিক প্রচার করা হয়েছে। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রচার এবং নির্বাচনে নৌকা ও আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রচারণার আধিক্য ছিল। বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলোর খবরে প্রতিযোগিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক এবং উৎসবমুখর নির্বাচনী পরিবেশের চিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। তারকাখ্যাতি সম্পন্ন প্রার্থীদের প্রচারণা সংক্রান্ত সংবাদের বহুল প্রচার হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার সক্ষমতা সংক্রান্ত খবরও প্রচার করা হয়েছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!