পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে গিয়ে উল্টো ‘পরিবেশের মামলা’ খেলেন কাউন্সিলর জসিম

পাঁচ ভূমিদস্যু নামে লিগ্যাল অ্যাকশনের আবেদন জানালেও নীরব প্রশাসন

ভূমিদস্যুদের কবল থেকে প্রায় সাড়ে পনেরো একর সরকারি সম্পত্তি উদ্ধারের জন্য সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে লিগ্যাল অ্যাকশনের আবেদন করেন ৯ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিম। কিন্তু তার করা আবেদনে সাড়া দেয়নি প্রশাসন। বরং তার বিরুদ্ধেই এবার পাহাড় কাটার অভিযোগ এনে মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

জানা গেছে, ২০২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসন, পুলিশ কমিশনারসহ দুর্নীতি দমন কমিশনে পাহাড় খেকোদের কবল থেকে সরকারি ১৫ একর ৩৯ শতক খাস জমি উদ্ধারে আবেদন করেন কাউন্সিলর জসিম। কিন্তু সেসব পাহাড় খেকোদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত কোনো অ্যাকশনে যায়নি প্রশাসন।

গত ১০ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরীর লেকসিটি এলকায় নিজ ব্যক্তি মালিকানাধীন এক জমিতে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কেটে করে ঘর নির্মাণ করার অভিযোগে নগরীর আকবরশাহ থানায় একটি মামলার আসামি হন কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিম। এ মামলায় তার স্ত্রী তাছলিমা বেগম ও মো. হৃদয়কে আসামি করা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পাহাড় কর্তন, গাছ নিধন ও সেমিপাকা ঘর তৈরির অভিযোগের বিষয়ে যাচাইয়ে সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয় ওই স্থান। সেখানে দেখা গেছে, আকবরশাহ থানার লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন কাউন্সিলর জসিমের ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড়ি সমতল জায়গায় তিন রুমের সেমিপাকা স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে। এসব ঘর তৈরি করা হয়েছে ১০ থেকে ১৫ বছর আগে। এ ঘরের পেছনেই রয়েছে সরকারি খাস পাহাড়ি জমি। খাস জমিঘেঁষা ব্যক্তি মালিকানাধীন এ পাহাড়ি টিলার সমতলে গড়া ঘরের সামনে দিয়ে নিচের দিকে নামতেই রয়েছে ডেইরি ফার্ম। সেই ডেইরি ফার্মের সামনেই ওই জমি। এ জমি আনুমানিক ৪০ ফুট ওপর থেকে নিচের দিকে নেমে এসেছে। তবে বৃষ্টির কারণে এ পাহাড়ি জমির মাটি নিচের দিকে নামলেও কাটার কোনো আলামত দেখা যায়নি।

তাছাড়া পাহাড়ধস রোধে দেওয়া হয়েছে বালির বস্তা। এর পাশেই সরকারি জমিগুলো ঝোপঝাড়ে ঠাসা হলেও এ জমিটি বৃক্ষরোপণের জন্য উপযুক্ত করে তোলা হচ্ছে। মূলত এ ঝোপঝাড় পরিষ্কার করেই পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার আসামি হয়েছেন কাউন্সিলর জসিম। ওই জায়গাটিতে বৃক্ষরোপণের জন্য তৈরি করা হয়েছে ১৭টি গর্ত। চারারোপণের প্রক্রিয়া হিসেবে জৈব সার দেওয়া হয়েছে। এতে পাহাড় কর্তনের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। তবে তিনটি কাটা গাছের গুঁড়ি দেখা গেলেও তা অনেক পুরনো।

একই সময়ে আশপাশের এলাকা পরিদর্শনে দেখা গেছে, সরকারি খাস পাহাড়ি জমি দখল করে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। তাছাড়া প্রচুর পরিমাণে পাহাড় কর্তনের আলামত রয়েছে। পাহাড় কেটে গড়া হয়েছে সেমিপাকা টিনশেড ঘর। তবে এসব স্থাপনা উচ্ছেদ বা পাহাড় কর্তন কর্ কারোর দিকে নজর পড়ছে না পরিবেশ অধিদপ্তরের। এতে রয়েছে যুবদল নেতাসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মানুষের দখল করা সরকারি খাস জমি। তাছাড়া পাহাড় খেকোরা প্রতি গণ্ডা এক লাখ থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে আসছেন এসব খাস জমি।

এ বিষয়ে কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিম বলেন, ‘গত ১৫ থেকে ২০ দিন আগে আমার ডেইরি ফার্মে যাওয়ার পথে একটি সাপ পায়ের নিচে পড়ে। ওই সাপ ঝোপঝাড়ের কারণে এ জায়গায় এসেছে। পরে সাপটি ডেইরি ফার্মে ঢুকে একটি গরুকে দংশন করলে গরুটি মারা যায়। এর কারণে আমি ঝোপঝাড় পরিষ্কার করে নতুনভাবে গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু গাছ লাগানোর সময় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে সাখাওয়াত সাহেব এসে কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। এসময় আমার জায়গার পাহারাদার ফোন করে আমাকে জানায়। পরে পরিবেশ অধিদপ্তর অফিসে যেতে নির্দেশ দিয়ে তিনি চলে যান। পরিবেশ অধিদপ্তরে গেলে তারা ১০ তারিখ শুনানিতে উপস্থিত থাকতে একটি নোটিশ দেন।’

তিনি আরও বলেন, পরের দিন ১০ আগস্ট সকাল ১১টায় পরিবেশ অধিদপ্তরে গেলে দুপুর দেড়টায় শুনানিতে জিজ্ঞেস করেন, পাশের জায়গা কী আপনাদের? তখন আমার পাহাড়াদার বললো—না। তবে আমাদের জায়গায় আমরা গাছ লাগাচ্ছি। এসময় তার কাছ থেকে জায়গার মালিক কে জানতে চাওয়া হয়। দলিল নিয়ে গেলে এর কপি রেখে তাদের চলে যেতে বলেন। এরপর জানান ‘আর কাজ কইরেন না।’

কাউন্সিলর জসিমের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে কাউন্সিলরকে আদালতে অভিযোগ করতে বলেন। এ বিষয়টি আদালত দেখবেন। আমার বা আপনার মাথা ব্যথা নয়। এটি বিচার বিভাগীয় বিষয়। আমাকে জিজ্ঞেস করার চেয়ে আদালতে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে বলেন।’

এর আগে সরকারি তিন দপ্তরে আবেদনে কাউন্সিলর জসিম পাঁচ ভূমিদস্যুর নাম উল্লেখ করেন। তারা হলেন, সাহাবউদ্দিন ওরফে ভূমি জাহেদ, আজাদ, ওসমান ওরফে কসাই ওসমান, আফছার ওরফে ভূমি দুলাল ও কাজী আলতাফ হোসেন। তারা এখনও লেকসিটি এলাকায় সরকারি খাস জমি ও পাহাড় দখল করে ভূমি বিকিকিনি করলেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো লিগ্যাল অ্যাকশন নেয়নি।

আরএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!