তেলের উত্তাপ ছড়াচ্ছে জেলেপল্লীতে, বিকল্প পেশা খুঁজছেন জেলেরা

জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে চট্টগ্রাম নগরীর জেলেপল্লীগুলোতে। একদিকে ভরা মৌসুমেও প্রত্যাশিত ইলিশ মিলছে না, তার ওপর তেলের দাম বৃদ্ধি—এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। এছাড়া ঋণ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে নামা জেলেরাও রয়েছেন চরম হতাশায়। এভাবে লাখ লাখ টাকা পুঁজি করে সাগরে নেমে ইলিশ ধরা যেন ভাগ্যের সঙ্গে জুয়া খেলা। এ অবস্থায় নানান সমস্যায় জর্জরিত অনেক জেলে মাছ শিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে বিকল্প পেশা খুঁজছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের কপালে দুশ্চিন্তায় ভাঁজ।

সরেজমিনে পতেঙ্গা, ইপিজেড ও কাট্টলী এলাকার জেলেপল্লীতে গিয়ে কথা হয় পান্না জলদাস, শেফাল জলদাস, নির্মল জলদাস, সুমন জলদাস, রকি জলদাস ও বাবুল জলদাসের সঙ্গে। তারা জানান, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরতে নেমেছে জেলেরা। কিন্তু সাগরে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। তার মধ্যে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। আগে যেখানে ১ লিটার তেল ছিল ৮০ টাকা এখন সেটা লিটারে ৩৪ টাকা বেড়ে হয়েছে ১১৪ টাকা। ইলিশ শিকারে গভীর সমুদ্রে যেতে হলে প্রতিদিন ১ টি বোটে ৩০ লিটার তেল খরচ হয়। আগে যেখানে জেলেদের ১টি বোটে প্রতিদিন ৮০ টাকা করে ৩০ লিটারে ২৪০০ টাকা খরচ হতো। এখন ৩০ লিটারে ১১৪ টাকা করে খরচ হচ্ছে ৩৪২০ টাকা। বোট প্রতি বেড়েছে ১০২০ টাকা। যা মাসে ৩০ হাজার ৬০০ টাকা বেশি।

জেলেরা আরও জানান, গত কয়েক দিন ধরে আমরা তিনবেলায় ৫০০০ থেকে ৬০০০ টাকার মাছ বিক্রি করছি। কিন্তু ১টি বোটে পাঁচজন জেলের দৈনিক বেতন ১ হাজার টাকা করে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। তারমধ্যে তাদের দৈনিক খাবার ২০০০ টাকা। জাল ও বোট খরচ ২ হাজার টাকা। এরসঙ্গে তেল খরচ ৩৪২০ টাকা। সব মিলে দৈনিক খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা। লাভতো দূরের কথা, দৈনিক লোকসান প্রায় ৬ হাজার টাকা। প্রতি জো-তে সাগরে জেলেরা সময় পায় ১৫ দিন। তারমধ্যে জো থাকে ৮ দিন, ডালা থাকে ৭ দিন এভাবে মোট ১৫ দিন। একটি বোটে দৈনিক খরচ ১২ হাজার টাকা করে ১৫ দিনে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখানে মাছ বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকা। লোকসান প্রায় ১ লাখ টাকা। ঋণ করে সুদের ওপর টাকা নিয়ে জেলেরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গায় রয়েছে প্রায় ২০০ মাছ ধরার বোট। এছাড়া ইপিজেড আকমল আলী রোডে ৪০০, বন্দর থানার আনন্দবাজারে ১০০, রাসমনি ঘাটে ৩০০, সাগরিকা খাজুতলি ঘাট ১০০টি ইলিশ ধরার বোট রয়েছে।

বোট মালিক ও মাছ ব্যবসায়ী মো. মুসলিম বলেন, ‘লাখ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে সাগরে ইলিশের ব্যবসা করছি। এ মৌসুমে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। পাশাপাশি তেলের দাম ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়ে গেছে। প্রতিটি বোটের জন্য মাসে বাড়তি তেল কিনতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকার।’

মাছের আড়তদার মো. আবদুল্লাহ বলেন, ‘হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়াতে বিপাকে পড়ে গেছি আমরা। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় মাছ পাঠাতে যে পরিবহন খরচ হতো, এখন তারচেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে। সব কিছু মিলে ব্যবসায় লোকসান ছাড়া লাভের মুখ দেখবো কি-না জানি না।’

উত্তর পতেঙ্গা জেলেপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি সোনা বাবু জলদাস বলেন, ‘আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দেখার কেউ নেই। মৎস্য অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক, স্থানীয় সাংসদ, সিটি মেয়র—সবাইকে বছরের পর বছর ধরে জেলেদের নানান প্রতিকূলতা ও দাবির কথা জানিয়ে আসছি। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে চাল ছাড়া কিছুই জুটে না। সরকারিভাবে জেলেদের ঋণের সুবিধা থাকলেও আমরা বঞ্চিত। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমরা আজ জর্জরিত। মৎস্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আমাদের দাবি ও সমস্যা কথা তুলে ধরলেও তা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দু‘বছরের মধ্যে আমাদের বাবা-দাদার পেশা ছেড়ে পথে বসতে হবে।’

সরকারিভাবে জেলেদের সুযোগ-সুবিধা ও ঋণ দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মৎস্য অধিদপ্তরে চাকরি করলেও আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কেন্দ্র ছাড়া আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারি না। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে হলে জেলেদের তাদের দাবিগুলো সংগঠনের মাধ্যমে কেন্দ্রে জানাতে হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!