পতেঙ্গায় সাগরপথে ‘বাবা আবছার’ সিন্ডিকেটের রমরমা মাদক বাণিজ্য, নেপথ্যে সাংবাদিকও

রাতের আঁধারে জোয়ারের মতো আসছে মাদক

চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকা মাদককারবারিদের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। মায়ানমার থেকে স্পিডবোটে মাদক এনে তা নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের বিদেশি বিয়ারসহ সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে ধরা পড়েছে এই চক্রের মূলহোতা। তবে তার সঙ্গে একটি অনলাইন টিভির সাংবাদিকসহ জড়িত আছেন তিনজন।

সোমবার (৩০ জানুয়ারি) ভোর পৌনে ৫টার দিকে নগরীর পতেঙ্গা থানার চরপাড়া পশ্চিম পাশের ঘাটে স্পিডবোট থেকে মাদকের চালান প্রাইভেটকারে বহন করার সময় দুজনকে আটক করা হয়। এই সময় ১৭৯১ পিস হ্যানিকেন বিয়ার জব্দ করা হয়। যার বাজারমূল্য ৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা।

আটক স্পিডবোট মালিক মো. রুহুল আমিন (৩১) ও প্রাইভেটকার চালক মো. নিজাম উদ্দিনকে (২৬) জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে আসে আরও দু’জনের নাম। তারা হলেন দক্ষিণপাড়ার নাগর আলীর নতুন বাড়ির মৃত বদিউল আলমের ছেলে, জব্দ প্রাইভেটকার মালিক মো. নুরুল আবছার ওরফে আবছার এবং একই থানার উত্তর পতেঙ্গা ফয়েজ আহম্মদের বাড়ির মো. ইউনুসের ছেলে সাইদুর রহমান সাকিব (৩০)।

মাদক উদ্ধার ঘটনার আগের রাতে পতেঙ্গার এক রেস্টুরেন্টে ইয়াবা আবছার ও সাকিব
মাদক উদ্ধার ঘটনার আগের রাতে পতেঙ্গার এক রেস্টুরেন্টে ইয়াবা আবছার ও সাকিব

এসব বিয়ার চোরাইপথে এনেছেন মো. নুরুল আবছার ওরফে আবছার নামের এক ব্যক্তি। মূলত তার ইশারায় পতেঙ্গায় চলে মদ-বিয়ারের রমরমা ব্যবসা। টাকার জোরে আওয়ামী লীগের পদ বাগিয়ে নিলেও মাদককাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া সাইদুর রহমান সাকিব চট্টগ্রামের এক অনলাইন টিভির নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত বলে জানা গেছে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জানুয়ারি ভোররাতে পতেঙ্গা থানার আউটার রিং রোডে চরপাড়াঘাট এলাকায় বিক্রয় করার উদ্দেশ্যে স্পিডবোটযোগে সাগরপথে আসে মাদকের এই চালান। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদককারবারিরা পালানোর চেষ্টা করলে স্পিডবোট মালিক মো. রুহুল আমিন ও প্রাইভেটকার চালক মো. নিজাম উদ্দিনকে (২৬) আটক করে র‌্যাব। তাদের সঙ্গে থাকা আরও দু’জন লোক পালিয়ে যায়। এ সময় ১৭৯১ পিস হ্যানিকেন বিয়ারের সঙ্গে প্রাইভেটকারটিও জব্দ করা হয়।

পলাতক দুই আসামি মো. নুরুল আবছার ওরফে আবছার ও সাইদুর রহমান সাকিবের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে মায়ানমার থেকে সাগরপথে আমদানি নিষিদ্ধ বিয়ার চোরাচালানের মাধ্যমে সংগ্রহ করে আসছে। পরে এসব মদ-বিয়ার ছড়িয়ে দিচ্ছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের ৩ জুন নগরীর পতেঙ্গা নেভাল রোডের চাইনিজ ঘাটের সামনে থেকে একটি বস্তাসহ নুরুল আবছারকে গ্রেপ্তার করে পতেঙ্গা থানা পুলিশ। তখন ওই বস্তায় ৪০ বোতল বিদেশি মদ পাওয়া যায়। পরে এ ঘটনায় পুলিশ নুরুল আবছারের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে। পরবর্তীতে এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্রও দেয় পুলিশ।

২০২১ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি বিদেশি মদ নিজ হেফাজতে রাখার দায়ে মাদক ব্যবসায়ী নুরুল আবছারকে ৪ বছর কারাদণ্ড দেন চট্টগ্রামের একটি আদালত।

এরপর ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দাবি ও ১৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনে পতেঙ্গা থানার তৎকালীন ওসিসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন মো. নুরুল আবছার। এই মামলায় আসামি করা হয় পতেঙ্গা থানার তৎকালীন ওসি আবুল কাশেম ভুঁইয়া, অপারেশন অফিসার (এসআই) প্রণয়, এএসআই তরুণ কান্তি শর্মা, এসআই আবদুল মোমিন, এএসআই কামরুজ্জামান, এএসআই মিহির, ইলিয়াস, জসিম ও নুরুল হুদাকে।

ওই মামলাটি চট্টগ্রাম মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালত থেকে স্থানান্তরিত হয়ে তদন্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্তে প্রমাণিত না হওয়ায় আবছারের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ এনে একটি মামলা দায়ের করে দুদক। গত ৯ ফেব্রুয়ারি সকালে এ মামলায় নুরুল আবছার আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনের আবেদন করেন। চট্টগ্রাম মহানগর বিশেষ দায়রা জজ আদালত শেখ আশফাকুর রহমান জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে তাকে পাঠানোর আদেশ দেন।

অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘদিন মাদক ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে উঠেছে আবছারের সম্পদ। দীর্ঘদিন কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না থাকলেও বাগিয়ে নেন আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য। পরে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি নুরুল আবছারকে ওই পদ থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়।

পতেঙ্গা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আনিসুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সোমবার মাদকসহ দু’জন আসামিকে মামলা দায়ের আগে থানায় হস্তান্তর করেছে র‌্যাব। এই মামলায় মোট চারজন নাম উল্লেখ রয়েছে। বাকি দু’জন আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!