নৈশপ্রহরীর দাপটে দিশেহারা শিক্ষক শিক্ষার্থী স্কুল কমিটি

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মনেয়াবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী মোস্তাফিজুর রহমান রুবেলকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিদ্যালয়টির শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা।

শুধু তাই নয়, তার সাথে ‘পেরে উঠছে না’ স্বয়ং বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরাও। গুরুতর অপরাধের পর খণ্ডকালীন এই নৈশপ্রহরীর চাকরি আর নবায়ন করেনি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। এরপর দেড় বছর চাকরি করেনি সেই নৈশপ্রহরী। কিন্তু তাকে এই দেড় বছরের বেতনসহ প্রায় দুই বছরের বেতন একসাথে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তার বেতন-ভাতা দেওয়া হতো আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার অধীনে। চাকরি না করেও দুই বছরের বেতন-ভাতা তুলে ‘বাহাদুরি’ দেখাচ্ছেন এই নৈশপ্রহরী। অভিযোগ রয়েছে তার এই ‘বাহাদুরির’ নেপথ্যে রয়েছেন খোদ উপজেলা শিক্ষা অফিসার। সম্প্রতি তাদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ জমা পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসারের দফতরে।

তবে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বলছেন, অভিযোগ উঠলেও স্থানীয় এমপি নজরুল ইসলামের কথায় তাকে চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছে।

দুদক ও জেলা শিক্ষা অফিসারের দফতরে পাঠানো অভিযোগ থেকে জানা গেছে, তিন বছরের চুক্তিতে ২০১২ সালে নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ হয় মোস্তাফিজুর রহমান রুবেলের। সাতকানিয়ার মনেয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাকে এ নিয়োগ দেয়। নিয়োগের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে উঠতে থাকে একের পর এক অভিযোগ। কখনো উঠেছে স্কুল ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ। কখনো অভিযোগ স্কুল আঙিনায় নেশা করার। আবার শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণের পাশাপাশি স্কুলের নলকূপ চুরির ঘটনায়ও অভিযুক্ত সে। বখাটেদের স্কুল আঙিনায় এনে আড্ডার আসর জমানোর পাশাপাশি উলঙ্গ হয়ে স্কুল ঘুরে বেড়ানোর মত গুরুতর অভিযোগও এই নৈশপ্রহরীর বিরুদ্ধে। এছাড়া রুবেলের বিরুদ্ধে অষ্টম শ্রেণীর সনদ জালিয়াতি করে চাকরি নেওয়া এবং বিদ্যালয়টির এক শিক্ষিকার স্বামীকে হুমকির অভিযোগও উঠে।

একপর্যায়ে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের পরামর্শে ২০১৮ সালে তার চাকরির মেয়াদ আর নবায়ন করেনি বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। কমিটির সদস্যদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর থেকে সে বিদ্যালয়ে আসেনি।

প্রায় দেড় বছর পর নৈশপ্রহরী রুবেল তাকে পুনরায় বিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়ার অনুরোধ জানায় শিক্ষকদের কাছে। কিন্তু বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার অনুরোধ ধোপে টিকেনি।

অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা শিক্ষা অফিসার আশিষ চিরাণের যোগসাজশে চাকরি না করেও উপজেলা ট্রেজারি থেকে দুই বছরের বেতন-ভাতা হাতিয়ে নিয়েছে রুবেল। এ জন্য সে আশ্রয় নিয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি ও প্রশাসনিক কিছু অসাধু কর্মকর্তার। তবে দুদক ও চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে পাঠানো চিঠিতে রুবেলকে এই অনৈতিক অর্থায়নের অভিযোগের তীর ছোড়া হয় সাতকানিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও মনেয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আহমেদ হোসেনের দিকে।

অথচ ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি নৈশপ্রহরী রুবেলের অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরে উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর চিঠি দেন প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় পরিচালনা সদস্য সচিব আহমেদ হোসেন। ওই চিঠিতে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি রুবেলের নৈশপ্রহরী পদে নিয়োগ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তও জানানো হয়।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত নৈশপ্রহরী মোস্তাফিজুর রহমান রুবেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ আমার বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের যে অভিযোগটি ছিল মিথ্যা। পরে এমপি মহোদয়ের সুপারিশের ভিত্তিতে এখন উপজেলা শিক্ষা দফতরে কর্মরত আছি। নিয়ম অনুসারে বেতন-ভাতাও দেওয়া হচ্ছে।’

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোশতাক আহমদ শিকদারসহ এই কমিটির সদস্যরা রুবেলের বিরুদ্ধে স্কুল ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি, স্কুলে মাদক গ্রহন, স্কুলের সম্পদ চুরির মত গুরুতর ১৪টি অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত হয়ে তার নিয়োগ নবায়ন করা থেকে বিরত থাকে। নিয়ম অনুযায়ী বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি যদি আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত নৈশপ্রহরীর চুক্তির মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর যদি নবায়ন না করে তাহলে চাকরি বাতিল হয়ে যায়। এ বিষয়টি উপজেলা শিক্ষা অফিসারকে অবহিতও করেছে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি। নিয়ম অনুযায়ী উপজেলা শিক্ষা অফিসার বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির চিঠি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা। কিন্তু চাকরি না থাকার পরও উপজেলা ট্রেজারি থেকে মনেয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরীর নামে দুই বছরের বেতন-ভাতা তুলে নেয় বলে অভিযোগ করেছে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্যরা৷

সাতকানিয়া উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশীষ চিরাণ এ বিষয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নৈশপ্রহরী রুবেলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের বিষয় রয়েছে। তবে এখানকার এমপি তাকে কর্মরত রাখতে সুপারিশ করেছেন।’ প্রতিবেদককে অভিযুক্ত নৈশপ্রহরী রুবেলের বিষয়ে এমপি নজরুল ইসলামের কাছ থেকে বিস্তারিত জানার ‘অনুরোধ’ও করেন আশীষ চিরাণ।

উল্লেখ্য, সাতকানিয়া উপজেলার মনেয়াবাদ প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান চন্দনাইশ সংসদীয় আসনে।

মুআ/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!