নাট্যাধার প্রযোজনা : নাট্যাখ্যান “হিড়িম্বা”-এর তৃতীয় প্রদর্শনী

বিনোদন প্রতিদিন ::

‘সৃস্টি হোক সচেতন মানুষ’ প্রতিপাদ্য নিয়ে গঠিত গ্রুপ থিয়েটার নাট্যাধার-এর দশম প্রযোজনা  নাট্যাখ্যান “হিড়িম্বা”-এর ৩য় প্রদর্শনী সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের জেলা শিল্পকলা একাডেমির আর্ট গ্যালারী মিলয়াতনে অনুষ্ঠিত হয় এ প্রদর্শনী।

এই  নাট্য প্রযোজনায় যা তুলে ধরা হয়েছে: মহাভারতের রাক্ষুসী চরিত্র হিড়িম্বা। হিড়িম্বার ভাই হিড়িম্ব’র হন্তারক পঞ্চপা-বের একজন ভীম। প্রেমের প্রবল টানে হিড়িম্বা ভাইয়ের খুনী ভীমকেই বিয়ে করেছিল নানা শর্ত মেনে। বিয়ের পর পুত্র ঘটোৎকচের জন্ম হওয়ার পর শর্তানুসারে হিড়িম্বা নিজের বাড়ি ফিরে যায়। কুরুক্ষেত্রে পা-বদের হয়ে লড়তে হিড়িম্বা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে গড়ে তোলা ঘটোৎকচকে পাঠায়। যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণের অস্ত্রে মারা যায় ঘটোৎকচ।

 

স্বামী পরিত্যক্তা, সন্তানহারা হিড়িম্বা এই নাট্যের পাটাতনে একে একে আহ্বান জানায় পা-বমাতা কুন্তী এবং পা-বভার্যা দ্রৌপদীকে। তাদের সঙ্গে বাহাসে লিপ্ত হয়। সেই বাহাসে একঅর্থে পরাজিত হয় তারা। আক্ষেপ ঝড়ে পড়ে হিড়ম্বার কণ্ঠে, কেননা রাক্ষস সম্প্রদায়কে আজো নেতিবাচক আর খল রূপেই চিত্রিত করা হয়। অথচ পৃথিবীর অনাচার সবতো মানুষেরই সৃষ্টি। এরপরও রাক্ষসের মহত্ব স্বীকৃত নয়, কেননা মানুষের মাঝে ‘কবি’ রয়েছেন, যিনি তার ক্ষমতাশালী কলমের জোরে মানুষের অন্ধকার ঢেকে তাকে আলোকময় আর কীর্তিমান করে গড়ে তুলতে পারেন।  হিড়িম্বা এক রাক্ষুসী, এক নারী হিসেবে এই বৈষম্যের অবসান দাবি করে।

????????????????????????????????????

ড. রুবাইয়াৎ আহম্মদ রচিত আখ্যান অবলম্বনে মোস্তফা কামাল যাত্রা নির্মিত নাট্যাখ্যান “হিড়িম্বা” নাট্যাখ্যানটি মহাভারতের অনালোচিত নারী চরিত্র রাক্ষসগোত্রীয়  হিড়িম্বার আত্মকথন চিত্রায়িত হয়েছে।

 

এই নাট্যাখ্যানের মাধ্যামে নারী সমাজ যে প্রাগৈতিহাসিক সময়কাল থেকেই নিগৃহিত এবং অবমূল্যায়িত তাদের ভূমিকা তাই যেমন তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বর্তমান চলমান সমাজ বাস্তবতাতেও  নারীর ভূমিকা যে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না তারই ইংগিত করা হয়েছে। একে তো নারী তার উপর রাক্ষুসী নারী। সুতরাং কবির কাব্যময়তায় তা বরাবর হচ্ছে উপেক্ষিত। আর প্রান্তিক নারী সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে সমাজে বর্তমানেও নারীর অবদানকে করা হচ্ছে অবমূল্যায়ন।

 

সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নারীর অবদানকে বিবেচনা করা হচ্ছে খাটো করে। যা করছে মানুষই, তা সে হোক পুরুষ কিংবা নারী। প্রকৃতপক্ষে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই এর জন্য দায়ী। হিড়িম্বা নাট্যাখ্যানের মাধ্যমে সভ্যতার এই উৎকর্ষময় সময়েও মানুষ; নারীর প্রতি সংবেদনশীল নয়। বরং নানান নেতিবাচক  কর্মকান্ডের  মাধ্যামে নারী সমাজকে  করছে অবমূল্যায়ন।

ডা. দিপঙ্কর দে’র সুর ও আবহে সৃষ্ট নাট্যাখ্যান “হিড়িম্বা”-এর রূপসজ্জা পরিকল্পক শাহীনুর সরোয়ার, পোষাক পরিকল্পক হারুন অর রশীদ, দ্রব্য-সম্ভার পরিকল্পক এ. আর. মুন্না আর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন নাদিরা সুলতানা হেলেন, তাসলিমা আক্তার, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সাবরীনা ইয়াছীন সাবা, এ. আর মুন্না, আসিফ উদ্দিন (শুভ), ইকবাল ইবনে মালেক, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মো. ফজলে রাব্বী, এ. আর. গনি এবং যন্ত্রী দলে থাকবেন রীপা পালিত, মো. সুলতান, অচিন্ত্য কুমার,  নারায়ন দাশ ও অলছেন দাশ।

রুবাইয়াৎ আহমেদ ‘হিড়িম্বা’ আখ্যানটি লিখেছিলেন আট থেকে নয় বছর আগে। এরপর এর পরিমার্জিত ও বর্ধিত রূপ ২০১৪ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। সাধারণত নেতিবাচক হিসেবে কাব্যে-পুরাণে কল্পিত রাক্ষস সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা হয়। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, শত অনাচার আর পাপের পরও মানব সম্প্রদায়ের মাঝে ‘কবি’ রয়েছে বলে তার অমিত প্রভাবশালী শব্দের শক্তিতে মানুষ শেষ পর্যন্ত মহীয়ান হয়ে ওঠে।

 

রাক্ষস নিজেকে বিলিয়ে দিয়েও মহত্বে উন্নীত হতে পারে না। কারণ তাদের মাঝে ‘কবি’ নাই। পাশাপাশি, সেই রাক্ষস সম্প্রদায়ের সদস্য যদি হয় নারী তবে তার অবস্থা আরো শোচনীয়। মহাভারতে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি অংশজুড়ে হিড়িম্বার কাহিনি। কিন্তু অতিঅল্প পরিসরেই নিশ্চিত হয়ে যায়, কোনো নারী চরিত্রের ত্যাগের চেয়ে হিড়িম্বার অবদান কোনো অংশেই ন্যূন নয় বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পূজ্য অনেক চরিত্র থেকেই বেশি। অথচ, এরপরও অপরাপর অনেক মানব নারী অসংখ্য ত্রুটি নিয়েও মহিমান্বিত হয়ে উঠেছে, পূজ্য রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আখ্যানকার এই বৈষম্যকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন ‘হিড়িম্বা’ নামক এই আখ্যান কিংবা নাটকের মধ্যদিয়ে।

 

দৃশ্যকাব্যের অভিপ্রায়ে নির্মিত কোনো রচনা যতক্ষণ পর্যন্ত মঞ্চে উদ্ভাসিত না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তার স্বার্থকতায় ঘাটতি থেকে যায়। দীর্ঘদিন পরে হলেও আখ্যানটি মঞ্চে আলোর মুখ দেখেছে নাট্যাধারের প্রযোজনায়। এই আখ্যানের খানিক জটিল ভাষা ও কাহিনি বিন্যাস মঞ্চে মেলে ধরতে অত্যন্ত পরিশ্রম করেছেন প্রযোজনার নেপথ্য ও মঞ্চ শিল্পিগণ। নাট্যাধারের এই প্রচেষ্টা দর্শকের মাঝে যদি ভাবনার সূত্রপাত ঘটায়, তাঁদের মনে যদি কিছুটা হলেও ভালোলাগার অনুভূতি সঞ্চার করতে পারে তবেই স্বার্থক হবে সবকিছু।

 

রিপোর্ট : রাজীব সেন প্রিন্স

এ এস / জি এম এম / আর এস পি :::

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!