ছোটমণি নিবাস/ ঈদের সকালে ‘মা’কে খুঁজে বেড়াচ্ছিল স্বজনহারা শিশুগুলো

মুচকি মুচকি হেসে খানিক পর পর খুব আদুরে গলায় ‘মা মা’ ডাকছিল দেড় বছরের আরাফাত হোসেন। তার ডাক শুনেই পাশ ফিরে তাকিয়ে ছোট্ট আরীবের চোখ খুঁজে চলছে মাকে। আয়া রুমা আক্তার তাদের ‘মা’ ডাকে সাড়া দিয়ে কোলে তুলে নিলেন পরম মমতায়। তবু কোথাও যেন শূন্যতা আর নেই নেই হাহাকার তাদের চোখের অপলক দৃষ্টিতে। ছোট্ট অবুঝ শিশুগুলোর জানা নেই কে তাদের বাবা-মা। মাস ঘুরে বছর গেলেও দেখা মেলে না আপন স্বজনের।

chittagong-roufabad-child-shelter-home

আনন্দের বার্তা নিয়ে ঈদ এলেও অনাথ শিশুদের জীবনে তা কেবলই দীর্ঘশ্বাস। স্বজন ছাড়াই কাটে তাদের ঈদ। বুকভরা কষ্ট নিয়ে এভাবেই বছরের পর বছর চার দেওয়ালের ভিতরে কাটছে তাদের জীবন।

chittagong-roufabad-child-shelter-home

চট্টগ্রামের রৌফাবাদে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘ছোটমণি নিবাসে’ একজন বৃদ্ধাসহ ২৫ জন অনাথ শিশুর জীবনের বাস্তব চিত্র এটি। ভাগ্যবিড়ম্বিত তাসফিয়া, মুক্তা, আরিফ, আরাফাত, মিনহাজ, মেহেদীসহ ২৫ শিশুর জীবনের গল্প এক ও অভিন্ন। তাদের কেউ কেউ হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া, আবার কেউ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শিশু। বাবা-মা, স্বজনহীন অনাথ শিশুদের ঠাঁই হয়েছে এই ‘ছোটমণি নিবাসে’।

chittagong-roufabad-child-shelter-home

ঈদের সাজপোশাক, খাবার থেকে শুরু করে ভালোবাসারও কমতি নেই ছোটমণি নিবাসে। তবু অবুঝ শিশুগুলোর প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা শূন্যতার মাঝে। ঈদ এলে আরো বেড়ে যায় অজানা কষ্ট । স্বজন ছাড়া থাকতে থাকতে এদের অনেকে ঈদ কী তাও বোঝে না। ঈদে নতুন জামা গায়ে দিয়ে বাবা মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ার আনন্দ থেকে তারা বঞ্চিত। বাবার হাত ধরে পথে হাঁটার আনন্দ তারা পায়নি কখনও। জীবনের নিয়মে এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যায় তাদের।

chittagong-roufabad-child-shelter-home

ছোটমণি নিবাসে অভাব নেই ভালোবাসার। দায়িত্বে থাকা প্রত্যেকেই নিজের সন্তানের চেয়ে বেশি খেয়াল রাখে এই অনাথ শিশুগুলোর। তবুও দিনশেষে অপ্রাপ্তির চাপ ভেসে ওঠে তাদের নিরীহ চোখেমুখে ।

আড়াই বছর বয়সের শিশু তাসফিয়া আক্তারকে খুঁজে পেয়েছিল জিআরপি থানা পুলিশ। থানায় জিডি করে তাকে তোলা হয় আদালতে। আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাকে প্রেরণ করা হয় ছোটমণি নিবাসে। এরপর সেখানে তার বেড়ে ওঠা। শিশু তাসফিয়া জানে না তার মা-বাবার পরিচয় কিংবা বাড়ির ঠিকানা। ছোটমণি নিবাসে ঠাঁই হওয়া তাসফিয়া গত ছয় মাস ধরে স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আগন্তুক দেখলে বড় আশা নিয়ে ছুটে আসে। এই বুঝি তার স্বজন এসেছে। কিন্তু পরক্ষণে তা মিলিয়ে যায় মেঘের মতো। মুখে না বললেও চোখের পাতায় স্পষ্ট ধরা পড়ে তার নীরব অশ্রু । তিন বছরের শিশু হৃদয়কে মা-বাবার কথা জিজ্ঞাসা করতে ছলছল চোখে জানায় “জানি না”।
কারিমা নামের এক শিশুর কাছে জানতে চাইলে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে- ‘বলতে পারি না।’ চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুই যেন তার নীরব অভিব্যক্তি। সে জানেই না তার বাবা-মা’র কথা। ভবিষ্যতে দেখা হবে কিনা তারও নেই কোনো নিশ্চয়তা। যেন তার নিয়তিতে লিপিবদ্ধ হয়ে গেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যত।

ঈদের প্রথম প্রহরে গোসল সেরে নতুন জামা গায়ে দিয়ে খেতে বসে পরোটা, সেমাই। বেলা ১১ টায় চটপটি। দুপুরের খাবারে পোলাও,খাসির রেজালা, মুরগির রোস্ট, দই আর কোমল পানীয়। বিকালের খাবারে নুডলস। রাতের খাবারে রয়েছে আজ সাদা ভাত, মাংস ও ডাল। এবারের ঈদে তাদের প্রত্যেকের নতুন জামা হয়েছে আটটি করে। প্রত্যেকে আদরে ভরভর থাকলেও চোখেমুখে আবছায়া কষ্ট ভেসে ওঠে।

ছোটমণি নিবাসের সর্বকনিষ্ঠ বাসিন্দা আরীব আবরার। আনুমানিক দেড় বছরের এ শিশুটি প্রতিনিয়ত মা-মা বলে খুঁজে বেড়ায় কাউকে। ছোটমণি নিবাসের রেজিস্টার থেকে জানা যায়, জন্মের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চুরি হয়ে যায় শিশু আবরার। পরে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর আদালতের মাধ্যমে ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর তার ঠিকানা হয় ছোটমণি নিবাসে।

আরিফের মতো আরেক অসহায় শিশু আরাফাতের জীবনের গল্পও একই। জন্মের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে ফেলে যায় স্বজনরা। এরপর হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চলার পর আদালতের নির্দেশে ২০১৮ সালের ২২ মার্চ তার ঠিকানা হয় ছোটমণি নিবাসে। এখন সেখানে কাটছে তার স্বজনহীন কষ্টের জীবন।

তাসফিয়া, আরিফ আবরার ও আরাফাতের জীবনের মতো মুক্তা, মিনহাজ, মেহেদীসহ ২৫ শিশুর জীবনের ভাগ্য যেন একই ফ্রেমে বন্দি। পরিবার থেকে হারিয়ে যাওয়া এ শিশুগুলো স্বজনদের খুঁজে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। ঈদ আসলে তাদের চাপা কষ্ট পরিণত হয় দীর্ঘশ্বাসে।

ছোটমণি নিবাসের দায়িত্বে থাকা বন্দনা জানান, ‘আমাদের বাচ্চাদের এখানে কোনো কষ্ট হয় না। এরা এখানে খুব ভালো আছে। আমরাও তাদের নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি যত্ন করি।’

ছোটমণি নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক শিল্পী ভৌমিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ” বাবা-মা ছাড়া ঈদ কি হয়! তবুও আমরা ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখে বড় করি তাদের। বাচ্চাগুলো আমাদেরই সন্তান। তাদের লালন পালন এবং পরবর্তীতে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে সমাজে পুনর্বাসন করাই আমাদের লক্ষ্য।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!