চট্টগ্রামে ‘ভিআইপি টিকা’র রমরমা ব্যবসা চসিকের হাসপাতালেই, রয়েছে ‘দুই নাম্বার’ টিকাও

দালাল ধরলে টিকা মেলে ১৪০০ থেকে ৪০০০ টাকায়

চট্টগ্রামে করোনা টিকার অবৈধ বাণিজ্য চলছে প্রকাশ্যেই। টিকাপ্রতি নেওয়া হচ্ছে সর্বনিম্ন ১৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। আর এই বাণিজ্য চলছে চট্টগ্রাম নগরীর সদরঘাটের কালিবাড়ি রোডে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত জেনারেল হাসপাতালেই। হাসপাতালের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যৌথ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চলছে টিকার এই কারবার। এজন্য তারা আশ্রয় নিচ্ছে অভিনব সব কৌশলের। অন্যদিকে চসিকের এই হাসপাতালে কর্মরত একাধিক কর্মী এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকলেও হাসপাতালেরই একাধিক সূত্র দাবি করেছেন, টিকাদানে নিয়োজিত দুজন কর্মী ছাড়া বাকিদের দেওয়া টিকা পুরোটাই ‘দুই নাম্বার’।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সপ্তাহব্যাপী অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালে করোনার দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে আসা প্রার্থীদের প্রথমে টিকার সংকট দেখিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তবে এদের মধ্যে যারা বিশেষ এজেন্ট বা কর্মকর্তা-কর্মচারীর রেফারেন্সে আসেন তারা টিকা পান। আবার যারা টিকার জন্য পীড়াপিড়ি করেন, তাদের কৌশলে বশে এনে টাকার বিনিময়ে টিকা ‘ম্যানেজ’ করে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চসিক জেনারেল হাসপাতালে কর্মরত কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ টিকা আলাদাভাবে মজুদ করে টিকার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখা হয় সেখানে। হাসপাতালে আসা টিকাপ্রত্যাশীদের কাছে টিকার ‘সংকট’ দেখিয়ে সরকারি বিনামূল্যের টিকায় বসানো হয়েছে বিশেষ ‘চাঁদা’।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টিকা নিতে আসা লোকদের কাছ থেকে টিকাপ্রতি সর্বনিম্ন ১৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৪০০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। আর অবৈধ এই টাকার ভাগ যায় সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালের আয়া-বুয়া থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পকেটেও।

করোনার টিকা ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে এই প্রতিবেদককে জানান, চট্টগ্রাম নগরজুড়ে দ্বিতীয় ডোজের ১ লাখ ২৪ হাজার টিকার সংকট থাকলেও ‘ভিআইপি’দের জন্য কিছু টিকা আলাদা করে মজুদ করে রাখে সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতাল। আর সেই ‘ভিআইপি কোটা’য় টিকা নিয়ে দেওয়ার নাম করে চলছে জীবনরক্ষাকারী করোনা টিকা বিক্রির রমরমা বাণিজ্য।

তবে সেই ‘ভিআইপি কোটা’র টিকা নিয়ে আবার নজিরবিহীন এক প্রতারণার কথাও জানিয়েছেন চসিকের এই হাসপাতালে কর্মরত একাধিক কর্মচারী। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, হাসপাতালের একাধিক কর্মী টিকা দেওয়ার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও এর মধ্যে শুধুমাত্র দুজন ছাড়া আর বাকিদের দেওয়া সব টিকাই ‘দুই নাম্বার’ বলে জানান তিনি। ওই দুজনের নাম সীমা ও ফোরকান বলে জানানো হলেও ‘দুই নাম্বার’ ধরন কী— সে বিষয়ে বিস্তারিত না জানালেও টিকার ভাওয়েলের ক্যাপে একটি বিশেষ চিহ্নের কথা জানান তারা।

টিকার জন্য মানুষের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের কারণে ভারত থেকে আসা অ্যাস্ট্রোজেনেকার তৈরি করোনার টিকা টাকার বিনিময়ে পেতেও চালাতে হয় তদবির। তবে নির্দিষ্ট এজেন্টের মাধ্যমে না গেলে ‘অরিজিনাল’ টিকা দেওয়া লোকদের নাগাল পাওয়া অসম্ভব। আর যারা চসিক হাসপাতালের নির্দিষ্ট দুজন কর্মী ছাড়া অন্য কর্মীদের নিয়োগ করা এজেন্টের খপ্পরে পড়ছেন, তারা চড়া মূল্য দিয়েও পাচ্ছেন ‘দুই নম্বর’ টিকাই— জানালেন হাসপাতালে কর্মরত ওই কর্মী।

আবার দেখা গেছে, সম্ভাব্য টিকাগ্রহীতাদের বিশ্বাস অর্জন করতে নানা কৌশলের আশ্রয় নেন এজেন্ট বা দালালরা। টার্গেট করা ব্যক্তিকে ‘এক নম্বর’ টিকা ও ‘দুই নম্বর’ টিকার ধরন ও পার্থক্য বুঝিয়ে ‘এক নম্বর’ টিকা পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তাও দেন এই এজেন্টরা।

নগরীর কাটগড়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকরি করেন মো. সাখাওয়াত। করোনা টিকার প্রথম ডোজ দেওয়ার সময় তাকে সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালে আনা হয়েছিল স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। আর স্বেচ্ছাসেবক হয়ে এসেই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি গড়ে তোলেন নিজের একটি সিন্ডিকেট।

টিকাপ্রত্যাশী সেজে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এই প্রতিবেদক এক দালালের রেফারেন্স দিয়ে যোগাযোগ করেন সাখাওয়াতের সঙ্গে। যোগাযোগের শুরুতেই তিনি ‘টিকার সংকট’ দেখিয়ে বলে দেন— ‘না হবে না, সম্ভব না।’ এর কিছুক্ষণ পরই সাখাওয়াত নিজেই প্রস্তাব দেন সেই ‘ভিআইপি কোটা’র টিকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার ব্যাপারে।

তবে এ সময় তিনি কিছু শর্তও বেধে দেন। যার প্রথমেই রয়েছে— ‘এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলা যাবে না।’ আর টিকাপ্রতি তাকে দিতে হবে ১ হাজার ৪০০ টাকা। সাখাওয়াত জানান, তার প্রস্তাবে রাজি হলে রোববার (১১ জুলাই) সাখাওয়াত নিজে কাটগড় থেকে এসে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবেন চসিক জেনারেল হাসপাতালে। তারপর সেখান থেকেই ‘ম্যানেজ’ করে দেবেন করোনার ‘ভিআইপি টিকা’।

সাখাওয়াত এ সময় এই প্রতিবেদককে বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘সরাসরি গেলে আপনাকে কেউ ধরা দেবে না। আমার রেফারেন্সে যেতে হবে। আমার সাথে গেলেই ইন্ডিয়ান কোভিশিল্ডের অরজিনাল টিকা পাবেন।’

টিকার জন্য অবৈধভাবে টাকা নিলেও সাখাওয়াত করোনার ‘অরজিনাল টিকা’ ও সাটিফিকেট দিয়ে সততার পরিচয় দেবেন বলেও আশ্বাস দেন।

এই ‘ভিআইপি টিকা’ তিনি কিভাবে ‘ম্যানেজ’ করেন— এমন প্রশ্নের উত্তরে সাখাওয়াত জানান, হাসপাতালের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মাধ্যমে এগুলো বের করা হচ্ছে। তবে অনেক অনুরোধের পরও সেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম বের করা সম্ভব হয়নি তার কাছ থেকে।

২৪ জুন মা-বাবাকে নিয়ে করোনার টিকা দিতে সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালে গিয়েছিলেন সূর্য সিংহ (ছদ্মনাম)। টিউশনি করে পরিবার চালালেও এই উচ্চশিক্ষিত বেকারের কাছ থেকেও টিকার নামে হাতিয়ে নেওয়া হয় টাকা। সূর্য এ সময় কিছু টাকা কম রাখার জন্য আকুতি জানিয়েও মন গলাতে পারেননি হাসপাতালের দালালদের। শেষ পর্যন্ত তিন হাজার টাকার বিনিময়ে মা-বাবাকে করোনার টিকা দিতে বাধ্য হন তিনি।

এমন ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার সূর্য একাই নন, এরকম আরও অনেকে আরও বেশি টাকার বিনিময়ে টিকা নিচ্ছেন বলেও জানান ভুক্তভোগী ওই তরুণ। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সূর্য সিংহ বলেন, ‘করোনার টিকা গরিবদের জন্য এখন বিলাসিতা। যাদের টাকা নেই, তাদের জন্য টিকাও নেই। আর সরকারের দেওয়া টিকাকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে বসেছে এই হাসপাতাল।’

চসিক জেনারেল হাসপাতালের নিচতলার দ্বিতীয় কক্ষেই এক দালালের মাধ্যমে বাবা-মায়ের টিকা দেন সূর্য সিংহ। সেখানে তিনি আরও দালাল দেখেছেন— এমন তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘যে যেভাবে পারছে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে টিকার নাম করে। নিশ্চয়ই তাদের শাস্তি হবে একদিন।’

এদিকে ‘টিকার দালাল’ সাখাওয়াত দামের ব্যাপারে খানিকটা নমনীয় হলেও বিন্দুমাত্র দাম ছাড়তে রাজি নন মেমনের অন্য ‘দালাল’ কাকলী পিসি। নিজেকে তিনি ‘নার্সের সহকারী’ হিসেবে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি হাসপাতালে আয়া হিসেবে কাজ করেন। সে হিসেবে তিনি হাসপাতালে ‘কাকলী পিসি’ নামেই পরিচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাকলী মাসির মাধ্যমে ‘অরিজিনাল টিকা’ নিতে চাইলে তাকে দিতে হয় ফিক্সড ২০০০ টাকা। এর বাইরে কাকলী মাসিকে ‘খুশি হয়ে’ও দিতে হয় আলাদা ফি।

তবে তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে সাখাওয়াত খানিকটা অনাগ্রহী হলেও তার রেফারেন্স দিয়ে ‘কাকলী পিসি’র সঙ্গে কথা বললে তিনি বেশ খোলামেলাভাবেই ‘ভিআইপি টিকা’ সংক্রান্ত নানা তথ্য জানান। কাকলী পিসি এই প্রতিবেদককে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘রোববার এসে জনপ্রতি ২০০০ টাকা দেবেন। আর টিকার বিষয়ে কোনো টেনশন করতে হবে না। আমি স্যারদের বলে সব ম্যানেজ করে রাখব। তবে মনে রাখবেন, আপনি এমনিতে গেলে কেউ টিকাও দেবে না, ধরাও দেবে না। তাই চুপচুাপ এসে টাকা দেবেন আর টিকা মারবেন।’

কাকলী পিসি আরও বলেন, ‘আমার মারফতে আসলে আসল টিকাটা পাবেন। ওখানে শুধু সীমা আর ফোরকান ছাড়া বাকি সবাই দুই নাম্বার টিকা মারে। আমি আপনাকে আসল টিকা নিয়ে দেব। তারপর আপনি ২০০০ টাকা ছাড়া আমাকে খুশি যা করার কইরেন।’

তিনি বলেন, ‘এখন টিকার সংকট, তাই কেউ কেউ ৩ হাজার নিচ্ছে, কেউ ৪ হাজারও নিচ্ছে। আপনি আমার কাছে আসছেন, তাই বেশি নিচ্ছি না। টাকা বেশি নিয়ে আমি পাপ করতে চাই না।’

পরে এই প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে সাখাওয়াতের সঙ্গে কথা বললে তিনি বিস্মিত হয়ে বলেন, ‘ভাই ওগুলো ভেতরের অফিসারদের নির্দেশে চলে। আমি তো এখন ওখানে নেই, তারপরও কেউ সাহায্য চাইলে সাহায্য করি।’

তবে বারবার ‘বড় অফিসারের’ কথা বললেও সাখাওয়াতের মুখ থেকে সেই বড় অফিসারের নাম বের করা সম্ভব হয়নি। তবে টাকার বিনিময়ে টিকা দেওয়াটা অন্যায়— একথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা ছোট চাকরি করি। যা করার বড় অফিসাররা করে। আমরা তো সামান্য চাকরিজীবী।’

এরপর ‘কাকলী পিসি’র নাম্বারে ফোন দেওয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরী বলেন, ‘অনেকদিন আগেই তো আমাদের টিকার কার্যক্রম শেষ হয়ে গেছে। আর কোনো টিকাই অবশিষ্ট নেই। ভিআইপি কোটা নামেও কোনো কোটা নেই। তারা কোত্থেকে কিভাবে টিকা মারছে আমি জানি না।’

এর আগে চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী গলিতে করোনার সরকারি টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজের’ জমজমাট ব্যবসা নিয়ে চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে করোনার টিকা বেচে কথিত সুইপার, দিনে আয় ১ লাখ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনে। ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘অস্থায়ী কর্মচারী’ হিসেবে এলাকায় পরিচয় দেওয়া এক লোক নগরীর হাজারী গলির একটি ঘরে নিজ হাতেই দিচ্ছেন করোনা টিকার ‘দ্বিতীয় ডোজ’। তবে চসিক সূত্রে জানা গেছে, বলয় আদৌ চসিকের পরিচ্ছন্নকর্মী নন।

এদিকে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হওয়ার পরও বলরাম চক্রবর্তী বলয়কে ধরা তো দূরের কথা, কোতোয়ালী থানার নাকের ডগায় এই ব্যবসা চলে আসলেও তাকে এমন ঘটনায় কোনো প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হয়নি। বলয়কে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের আগে কোতোয়ালী থানাকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করা হলে সেই রাতেই বলয়কে আটক করার জন্য এই প্রতিবেদকের কাছে তার বৃত্তান্ত জানতে চায় কোতোয়ালী থানা পুলিশ। কিন্তু সেই ‘টিকা ব্যবসায়ী’কে ধরতে রাতে যতটা ‘তৎপর’ ছিল পুলিশ, খবর প্রকাশের পর দিনে ততোটাই নিরবতা নেমে আসে কোতোয়ালী থানায়। করোনার টিকা নিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে কোতোয়ালী থানার ওসির সাথে পরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি শুধু ‘তদন্ত চলছে’ জানিয়ে আশ্বস্ত করেছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!