চট্টগ্রামে থানায় ডেকে মানসিক নির্যাতন, রাতেই যুবকের আত্মহত্যা

চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরির (জিডি) তদন্ত করতে ডাকা হয় কলেজছাত্র মিনহাজুল ইসলাম রাফিকে। সন্ধ্যায় থানায় রাফির মা-বাবাও সঙ্গে আসেন। এ সময় হঠাৎ তার মোবাইল জব্দ করে পুলিশ। পুলিশ অভিযোগ তোলে, সাবেক প্রেমিকার সঙ্গে থাকা অন্তরঙ্গ ছবি ব্ল্যাকমেইল করেছেন রাফি। এ সময় রাফিকে মানসিকভাবে নির্যাতন করে পুলিশ। নিজের মা-বাবার কাছে এভাবে অপদস্থ হওয়ায় অপমানে থানা থেকে ফিরেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন রাফি।

মিনহাজুল ইসলাম রাফির পরিবারের দাবি, কোতোয়ালী থানার পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) আরমান হোসেন তাকে প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন করেন। ওসি-তদন্ত এ সময় দুই লাখ টাকা চাঁদাও দাবি করেন। মা-বাবার সামনে অপমানও করা হয় রাফিকে।

বুধবার (২০ ডিসেম্বর) রাতে চট্টগ্রাম নগরীর লালখানবাজার টাংকির পাহাড় এলাকার বাসায় ফিরেই গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন মিনহাজুল ইসলাম রাফি। ২১ বছর বয়সী এই তরুণ ওই এলাকার সিএনজিচালক মো. মামুনের ছেলে। তিনি নগরীর একটি কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আত্মহত্যার পর রাফির লাশ উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়েছে।

কোতোয়ালী থানার পুলিশ দাবি করেছে, দীর্ঘদিন মামুনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কোতোয়ালী থানা এলাকার এক কিশোরীর। প্রেমের এক পর্যায়ে ঘটনাটি জানতে পারে মেয়েটির পরিবার। এরপর রাফির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বারণ করে। মেয়েটিও পরিবারের কথাতে সায় দেয়। কিন্তু তাতে বাধ সাধেন রাফি। মেয়েটির মা-বাবা ও আত্মীয়দের ফোন করে তাদের অন্তরঙ্গ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন রাফি।

পুলিশের দাবি, মেয়েটির পরিবার গত ৯ ডিসেম্বর কোতোয়ালী থানায় রাফির বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে। আদালতের নির্দেশে সেই অভিযোগের তদন্ত করতে থানায় ডাকা হয় রাফিকে। কিন্তু এসব ঘটনার কিছুই জানতেন না তার বাবা-মা।

কোতোয়ালী থানার পুলিশ দাবি করেছে, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করার কথা ‘স্বীকার’ করেন রাফি। এমনকি তার মোবাইল ফোনে কয়েকটি অন্তরঙ্গ ছবিও খুঁজে পান পরিদর্শক (তদন্ত) আরমান হোসেন। এমন ঘটনায় ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে ক্ষমা চান রাফির মা-বাবা। এক পর্যায়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তার পা ধরে কান্নাকাটি করার মতো ঘটনাও ঘটে।

কোতোয়ালী থানার ওসি-তদন্ত আরমান হোসেন বলেন, ‘আমি ছেলেটির বাবা-মাকে বলি, পা ধরে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ হবে না, যদি ছেলেকে বিপদমুক্ত করতে চান তাহলে মেয়েটির পরিবারের কাছে গিয়ে ক্ষমা চান। তারা যদি অভিযোগটি তুলে নেন, তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপর থানা থেকে বের হয়ে নিজ ঘরে গিয়ে অপমানে গলায় মাফলার পেঁচিয়ে আত্মহনন করেন রাফি।’

তবে রাফির বাবা সিএনজিচালক মো. মামুন পুলিশের এই দাবিকে মিথ্যা উল্লেখ করে বলেন, ‘রাফিকে এই অভিযোগে হাজতে চালান করে দেবে—এমন ভয় দেখিয়ে দুই লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন ওসি-তদন্ত আরমান। এ সময় আমার কাছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা আছে জানালে সেই টাকাগুলো ওসি-তদন্ত আরমান বাথরুমে রেখে আসার নির্দেশ দেন। বাকি ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ২৪ ডিসেম্বরের মধ্যে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এছাড়া থানায় থাকাকালীন রাফিকে মানসিক নির্যাতন করা হয়।’

পুলিশের মানসিক নির্যাতনে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ছেলের আত্মহত্যার ঘটনায় আইনের আশ্রয় নেবেন কিনা— এমন প্রশ্নে নিহতের বাবা মো. মামুন বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, ওদের সঙ্গে তো পারবো না। ছেলে তো হারাইছি, আর কিছু করতে গেলে ওরা (পুলিশ) বিপদে ফেলবে আমাদের।’

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোতোয়ালী থানার ওসি-তদন্ত আরমান হোসেন বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো মিথ্যা যুক্তি আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো হচ্ছে। আমি রাফির মা-বাবাকে থানায় ডেকে পাঠাইনি, রাফিই নিজের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তাদের থানায় এনেছে। এছাড়া রাফিকে আমি হাজতে পাঠাবো যদি টাকা না দেয়, কিন্তু জিডিমূলে তো কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না। আমি তো প্রথমবারই এই অভিযোগের তদন্তের স্বার্থে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্য থানায় ডেকেছি।’

চাঁদা দাবির বিষয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেন, ‘এগুলো জাস্ট কথার কথা, আমি কোনো ধরনের টাকা দাবি ও মানসিক নির্যাতন করিনি। আপনারা চাইলে আমার রুমের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে পারেন। কাউকে মানসিক নির্যাতন করলে তো সেই চিত্র ভিডিও দেখে হলেও কিছুটা বুঝতে পারবেন।’

এ বিষয়ে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম ওবায়েদুল হক বলেন, ‘রাফির বিষয়টি আমি শুনেছি। আমি আরমান সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। যে অভিযোগটা ওনার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তিনি তেমন প্রকৃতির মানুষ না। তারপরও যেহেতু একটা প্রশ্ন উঠেছে, আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

বিএস/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!