চট্টগ্রামে খেলার অন্ধকারে আলো ছড়াচ্ছে ফরিদের অ্যাকাডেমি

ছেলেদের পাশাপাশি অনুশীলন করছে মেয়েরাও

চট্টগ্রাম নগরীতে খেলার মাঠের সংকট দীর্ঘদিন ধরেই। হাতেগোনা যেসব মাঠ আছে তার অধিকাংশই খেলার অযোগ্য। আর এ কারণে শিশু-কিশোররা খেলাধুলায় বিমুখ হয়ে পড়ছে। এমন অবস্থায়ও নগরীর পতেঙ্গা এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন ফরিদ উদ্দিন। ১৫ বছর ধরে তিনি এলাকার ছেলেমেয়েদের শেখাচ্ছেন ফুটবল। তিনি ‘পতেঙ্গা ফরিদ ফুটবল অ্যাকাডেমি’ তৈরি করেছেন এলাকার ছেলেমেয়েদের খেলামুখি করার জন্য। তার এই একাডেমিতে এখন প্রায় দু’শ’য়ের বেশি ছেলেমেয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এছাড়ার তার অনেক শিষ্য খেলছে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রতিযোগিতায়।

প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে সকাল ৮টা এবং বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের অনুশীলন করান ফরিদ উদ্দিন। তার অ্যাকাডেমিতে ছেলেদের পাশাপাশি ২০ জন মেয়েও ফুটবল প্রশিক্ষণ নেন।

পতেঙ্গার ছেলে ফরিদের বাবার নাম হাজী নুরুল আলম সর্দার। তিনি বাবা-মায়ের ৫ম ছেলে। তবে শুরুটা তার ক্রিকেট দিয়েই। খেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেট লিগে। কিন্তু বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি ক্রিকেটে। এরপর জড়ান ফুটবলের সঙ্গে। খেলতে থাকেন পেশাদার ফুটবল লিগে। চট্টগ্রাম আবাহনীর মতো দলের হয়ে মাঠে নেমেছেন তিনি।

তবে খেলোয়াড়ি জীবন থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে তিনি চলে আসেন প্রশিক্ষণ জগতে। নিজ এলাকায় খেলোয়াড় তৈরির জন্য গড়ে তোলেন ফুটবল অ্যাকাডেমি। পরে তার এ অ্যাকাডেমি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) অনুমোদন পায়।

ফরিদ উদ্দিন এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন থেকে ‘বি’ লাইসেন্স ও ‘সি’ লাইসেন্স পান তিনি। এছাড়া চট্টগ্রামের একমাত্র কোচ হিসেবে জিকে লেভেল ওয়ান সার্টিফিকেট অর্জন করেন। তিনি অগ্রণী ব্যাংক ক্লাব, ফরটিস এফসি দলের সহকারী কোচ ছিলেন। পরে প্রধান কোচ হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম আবাহনীর অনূর্ধ্ব-১৮ দলের সঙ্গে।

বর্তমানে সিজেকেএসের অনূর্ধ্ব-১৬ আবাসিক ফুটবল ক্যাম্পের গোলরক্ষক কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ফরিদ। তবে তার স্বপ্ন, ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের কোচ হওয়া।

ফরিদের হাত ধরে গত ১৫ বছর প্রায় এক হাজার ফুটবলার তৈরি হয়েছে। তারা খেলেছেন দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার প্রতিযোগিতায়। এদের মধ্যে মো. মিজানুর রহমান বাংলাদেশ ফুটবল প্রিমিয়ার লিগ ও বাংলাদেশ পুলিশ এফসিতে, মো. ফাহিম দিলকুশার হয়ে ঢাকা প্রথম বিভাগে, মো. আরাফাত বাবু কল্লোল সংঘের হয়ে ঢাকা দ্বিতীয় বিভাগে, মো. ইমন বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-২০ দলে, মো. মনির বিপিএল উওরা এফসির হয়ে খেলছেন। এছাড়া প্রিমিয়ার লিগ, বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন লিগ, ঢাকা তৃতীয় বিভাগ, ঢাকা পাইওনিয়ার, চট্টগ্রাম তৃতীয় বিভাগ এবং পাইওনিয়ার দলেও খেলছেন অনেকে।

সর্বশেষ তার শিষ্য মাইকেল দাশ সুযোগ পেয়েছেন ফরটিস ফুটবল ক্লাবের হয়ে খেলার।

পতেঙ্গা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রমি দাশ বলেন, ‘দু’বছর ধরে আমি বিনা বেতনে পতেঙ্গা ফরিদ ফুটবল অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। শুরুতে আমার পরিবার ও প্রতিবেশীরা ভালো চোখে দেখেননি কিন্তু প্রশিক্ষক ফরিদ উদ্দিন আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। উনি নারী ফুটবলারদের খুবই মূল্যায়ন করেন। উনার কারণেই পতেঙ্গায় আমরা মেয়েরা ফুটবল প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছি। খেলোয়াড় হিসেবে সামরিক বাহিনীর সৈনিক হয়ে খেলবো, এটাই আমার স্বপ্ন।’

ফুটবল কোচ মো. ফরিদ উদ্দিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন কোনোভাবেই বিপথে না যায়, সেজন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও সমাজকে মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত গড়তে প্রয়োজন খেলাধুলার। যে বয়সে যুবকদের মাঠে থাকার কথা তার বদলে ওরা ব্যস্ত মোবাইল হাতে, গেমস ও প্রযুক্তিতে। তারা যাতে খেলাধুলামুখি হয় সে চেষ্টা করছি। তবে খেলাধুলার পর্যাপ্ত মাঠ না থাকায় বেশ সমস্যায় ভুগতে হয় আমাদের। ভালোভাবে অনুশীলন করানো যায় না। সেইসঙ্গেতো আর্থিক অনটন আছেই। পৃষ্ঠপোষক না থাকায় খেলোয়াড়দের জার্সি ও খেলাধুলার সামগ্রী জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হয়। পতেঙ্গা এলাকায় আধুনিক ফুটবল অ্যাকাডেমির খুবই প্রয়োজন।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে যদি আউটার রিং রোডের আশপাশে কোনো সরকারি খাস জমিতে যদি একটি বড় মাঠ তৈরি করা হয় তাহলে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলায় আগ্রহ বাড়বে। সমাজের বিত্তবানরা যদি খেলাধুলার প্রসারে এগিয়ে আসেন তাহলে বিপথে যাবে না যুবসমাজ।’

পতেঙ্গার কাউন্সিলর সালেহ আহমেদ চৌধুরীর ছেলে মো. ওয়াহিদুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘নগরজুড়ে বিভিন্ন ওয়ার্ডে খেলার মাঠ না থাকায় প্রযুক্তি ও মাদক কেড়ে নিচ্ছে শিশুদের সোনালী শৈশব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অনিশ্চিত দিন আসছে। খেলোয়াড় তৈরির ক্ষেত্রে যারা ক্রীড়া সংগঠক তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়ে আমাদের খেয়াল রাখা দরকার। এক্ষেত্রে সিজেকেএস, বাফুফে, মেয়র, স্থানীয় সাংসদ ও কাউন্সিলরসহ ক্রীড়ানুরাগীদের এগিয়ে আসতে হবে।’

আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক আনোয়ারা আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিশুরা অবারিত সবুজে খেলাধুলার সুযোগ পায় না। শিশুদের খেলাধুলা এখন মোবাইলে। মোবাইলে আসক্তির কারণে শিশুরা বন্ধুদের সঙ্গে মাঠে খেলাধুলা, গল্প করে সময় কাটানো, বেড়াতে যাওয়া—সবকিছু থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ছে। কিশোরদের মধ্যে মাঠে খেলাধুলার প্রবণতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এখন কিশোরদের সময়কাটে আড্ডায় আর টিকটকের নেশায়। আমাদের আগামী প্রজন্মকে নিয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভাবা দরকার। এখনই যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তাহলে রাষ্ট্রকে চরম মূল্য দিতে হবে।’

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডেই খেলার মাঠের সংকট। আমি মেয়র থাকাকালীন সময়ে নগরীর বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারি জায়গাগুলো যেখানে শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতো, সেগুলো রক্ষা করতে বার বার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। ব্যক্তি মালিকরা না চাইলে সেক্ষেত্রে আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একমাত্র সরকারের জোড়ালো পদক্ষেপই পারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে।

তিনি আরও বলেন, ‘চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) আওতায় বিভিন্ন ক্লাবগুলোকে আমরা সাহায্য সহযোগিতা করে থাকি। কিছু নিয়ম থাকার কারণে সিজেকেএস খেলাধুলার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সংগঠনগুলোকে সরাসরি সহযোগিতা করতে পারে না। আমি শুনেছি পতেঙ্গা ফরিদ ফুটবল অ্যাকাডেমি দীর্ঘদিন শিশু-কিশোরদের ফুটবল প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। তারা চাইলে যেকোনো বিষয়ে সহযোগিতার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!