সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই সম্মেলন হতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের। ২০ বছর পর হতে যাওয়া এই সম্মেলনকে ঘিরে অনুষ্ঠানস্থল থেকে শুরু করে আশপাশ ছেয়ে গেছে ব্যানার-ফেস্টুনে। কিন্তু তারপরও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সরকারি চাকরিজীবী আহ্বায়ককে নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এরমধ্যে তিনি আবার উত্তরের সভাপতি পদপ্রার্থীও হয়েছেন।
এছাড়া চট্টগ্রাম নগর ও দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের অবস্থাও টালমাটাল। দক্ষিণের কমিটির যেখানে মেয়াদ ফুরিয়েছে চার বছর আগে, সেখানে নগরে কমিটি পাওয়ার পরও চলছে দুই গ্রুপের নেতাদের মধ্যে ‘গৃহযুদ্ধ’।
এদিকে ২০০৩ সালে শওকতুল আলমকে সভাপতি ও বেদারুল আলম চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলার এডহক কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এরপর ২০১৩ সালে সম্মেলনের উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। সম্প্রতি মো. এরাদুল হক নিজামী ভুট্টোকে আহ্বায়ক ও মো. নাছির উদ্দিন রিয়াজকে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্যের উত্তর জেলার সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিও গঠন করা হয়।
তবে ভুট্টো আহ্বায়ক হওয়ার পর তার কর্মজীবন নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। চট্টগ্রাম সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে অফিস সহকারী পদে কর্মরত ভুট্টো আবার মিরসরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এর আগে মিরসরাই উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়কও ছিলেন। সরকারি কর্মচারীদের যেখানে রাজনীতি করা নিষেধ সেখানে ভুট্টো পেয়েছেন একের পর এক রাজনৈতিক পদোন্নতি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাফিউল করিম নাফা বলেন, ‘প্রায় দুই দশক পর উত্তরের সম্মেলন হচ্ছে। তাই উত্তরের সাতটি উপজেলার নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ভুট্টোর বিষয়টি আমি একাধিকজনের কাছ থেকে শুনেছি। ইতোমধ্যে আমি কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে জানিয়েছি, ওনারা ব্যবস্থা নেবেন।’
তবে স্থানীয় রাজনীতিতে স্থানীয় নেতাদের ইচ্ছে সুপারিশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে উত্তরের জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, হাসান মাহমুদ ভাইদের ইচ্ছেকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে জানান নাফা।
মঙ্গলবার (২৫ জুলাই) নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংগঠনটির উত্তর জেলা ইউনিটের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। কমিটির জন্য সভাপতি ও সম্পাদকসহ বিভিন্ন পদে অন্তত ১২০ জন প্রার্থী কেন্দ্রকে জীবন বৃত্তান্ত দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সভাপতি প্রার্থী বলেন, ‘সাবেক ছাত্র-যুবনেতার মধ্যে ত্যাগী ও যোগ্য অনেকেই আছেন, যাদের এই পদে দেওয়া যেতো। নেতার কী এতোই আকাল পড়ে গেলো যে, একজন সরকারি কর্মচারীকে আহ্বায়ক বানাতে হলো। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, হয় তিনি চাকরি করবেন, নয়তো রাজনীতি।’
নগর কমিটিতে ‘গৃহযুদ্ধ’
প্রায় ২০ বছর পর গত বছরের মার্চে দেবাশীষ নাথ দেবুকে সভাপতি ও আজিজুর রহমান আজিজকে সাধারণ সম্পাদক করে তিন বছরের জন্য আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে এক সপ্তাহের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণারও কথা জানানো হয়।
তবে এই কমিটির মেয়াদ ১৫ মাস পার হলেও এখনও পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়নি। বরং ২০ জনের এই কমিটি দু’ভাগ হয়ে চলছে ‘গৃহযুদ্ধ’। অন্যদিকে সংগঠনটির সভাপতি দেবাশিষ নাথ দেবুকে এখনো কোটি টাকার চাঁদাবাজির মামলায় চক্কর কাটতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়।
নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগে নাছির-নওফেল বলয়ের মধ্যে চলমান এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কমিটির অন্যরাও। যদিও কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক দুজনেই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী।
কমিটি ঘোষণার পর মাসখানেক পর্যন্ত উভয় গ্রুপের নেতাদের একসঙ্গে অনুষ্ঠান করতে দেখা গেলেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে অন্তঃকোন্দল। সর্বশেষ চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনে সম্পূর্ণ আলাদাভাবেই প্রচারণা চালাচ্ছে দুই বলয়ের নেতারা। সর্বশেষ রোববার নাছিরপন্থী নেতারা নিজেদের মতো করে প্রচারণা চালান হালিশহর এলাকায়। আর নওফেলপন্থীরা ছিলেন অন্য এলাকায়।
নগর কমিটি নিয়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নাফা বলেন, ‘এই রকম কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমাদের বর্ধিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এই মাসেই নগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। কিন্তু আমাদের অন্য জেলাগুলোতে সম্মেলন চলায় ব্যস্ততার জন্য আর হয়ে ওঠেনি। তবে সেপ্টেম্বরে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ হবে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি।’
নগর কমিটির সহ-সভাপতি হেলাল উদ্দীনের বড় ভাই মহিউদ্দিন বাচ্চু নৌকা প্রতীকে উপনির্বাচন করছেন। আলাদা প্রচারণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সভাপতি-সম্পাদক সংগঠনকে নিজেদের সম্পদে পরিণত করেছেন। দলীয় কর্মসূচি নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলাপ করেন না। নিজেদের ইচ্ছে হলে হঠাৎ করে আগের রাতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে একটা কর্মসূচি দিয়ে দেন। লিখিত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না। উপনির্বাচনেও একই অবস্থা হচ্ছে। তারা বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিজেদের লোক দেখে দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছেন। এভাবে একটা সংগঠন চলতে পারে না।’
তবে নওফেলপন্থী নেতাদের দাবি ডাকলেও দলীয় অনুষ্ঠানে আসেন না নাছিরপন্থী নেতারা।
এই বিষয়ে নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ বলেন, ‘কমিটি ঘোষণার পর থেকে তারা বিপুল পরিমাণ সদস্য সংগ্রহসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটির ১০১ জনের তালিকাও কেন্দ্রে জমা দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি সংগঠনের কর্মসূচিতে না আসে জোর করে আনা যায় না।’
মেয়াদ ছাড়াই চলছে দক্ষিণের কমিটি
২০১৬ সালে মোহাম্মদ জোবায়েরকে সভাপতি ও চৌধুরী মোহাম্মদ গালিব সাদলীকে সাধারণ সম্পাদক করে তিন বছরের জন্য দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি গঠন করা হয়। পরে ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিও গঠন করা হয়। বর্তমানে এই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। তৃণমূল থেকে দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলনের দাবি জানানো হলেও এই বিষয়ে মনোযোগ নেই সভাপতি ও সম্পাদকের।
বর্তমানে জোবায়ের সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র ও গালিব বাঁশখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
তৃণমূলের কর্মীরা দক্ষিণে নতুন কমিটি ঘোষণার দাবি জানালেও কেন্দ্র থেকে জানানো হয়, নির্বাচনের আগে কমিটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
দক্ষিণের একাধিক নেতা জানান, সভাপতি-সম্পাদক দু’জন নিজেদের দাপ্তরিক দায়িত্ব নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, দলীয় কর্মসূচি নেই বললেই চলে। এমনকি জাতীয় দিবসগুলোতেও সংগঠনের কর্মসূচিতে তাদের পাওয়া যায় না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন, ‘এই কমিটি যে আছে, সেটাও অনেকে জানেন না। উনারা নিজেদের ইচ্ছে হলে মাঝে মধ্যে পছন্দমতো স্থানে টুকটাক কিছু কর্মসূচি পালন করেন।’
ডিজে