অসহায় নারীর একখণ্ড জমি দখলে নিতে বেপরোয়া রানা-তালেব-পেয়ারের চক্র

বাধা দেওয়ায় ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা

জমিটির পরিমাণ মাত্র এক গণ্ডা। ওই জমির মালিক রীনা আক্তার নামে এক নারী। তিনি অসহায় জেনে ছলেবলে এই জমি দখলে নিতে চান স্থানীয় এক ব্যক্তি সাহেদ আলী রানা। গায়ের জোরে জমিটি দখল করতে গেলে রীনা আক্তারের আত্মীয় চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানা ছাত্রলীগের নেতা নুরুল বশর বিপলু বাধ সাধেন। এই একখণ্ড জমি নিয়ে বিপলুর সাথে দ্বন্দ্ব শাহেদ আলী রানা ও তার ভাই তালেব আলী এবং রানার সহযোগী পেয়ার মোহাম্মদের। পেয়ার মোহাম্মদ যুদ্ধাপরাধের দায়ের ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা) রাজনৈতিক ‘সহযোদ্ধা’। সাকা চৌধুরীর সাথে রয়েছে তার ছবিও।

আত্মীয়ের জমির পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় ‘কিশোর গ্যাং লিডারের’ তকমাও দেওয়া হয় বিপলুকে। প্রতিপক্ষ তার বিরুদ্ধে দিয়েছে একের পর এক মামলা ও অভিযোগ। শুধুমাত্র জমি নিয়ে বিরোধকে কেন্দ্র করেই এই ছাত্রলীগ নেতাকে পুলিশ, র‍্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

আবার যারা বিপলুকে কথিত কিশোর গ্যাং লিডার হিসেবে প্রচার করছে সেই রানা আবার বিপলু ও তার রাজনৈতিক সহযোগী আরিফের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ওই জমির মালিক নারী হওয়ায় তাকেও নানা সময়ে হুমকি দিয়ে আসছে শাহেদ আলী রানা— এমন অভিযোগও জমা পড়েছে থানায়।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সাথে মুঠোফোনে সাহেদ আলী রানা ও পেয়ার মোহাম্মদের আলাপকালেও বিপলুর সাথে তাদের দ্বন্দ্ব যে ওই একখণ্ড জমি নিয়ে— তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ‘সহযোদ্ধা’ পেয়ার মোহাম্মদ
যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝোলা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ‘সহযোদ্ধা’ পেয়ার মোহাম্মদ

জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশ থানার হামজারবাগের হামজা খাঁ লেইন এলাকায় রীনা আক্তারের এক গন্ডা জমি রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই জমি দখলে নিতে চান স্থানীয় শাহেদ আলী রানা। এ জন্য রানা ও তার অনুসারীরা রীনাকে চাপ দিতে থাকেন নানাভাবে। রাস্তায় রীনাকে দেখলে তারা আপত্তিকর আচরণ করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে ওই জমির খতিয়ান বাতিল চেয়ে চলাচলের রাস্তা বানানোর আবেদন জানান রানা। ২০১৬ সালে আগে চান্দগাঁও সদর সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর আবেদনও করেন তিনি। দুই বছর শুনানির পর এই তার আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এরপরও ওই জমি দখলের চেষ্টায় লিপ্ত থাকে শাহেদ আলী রানা, তার ভাই তালেব আলী ও পেয়ার মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি। কিন্তু রীনা আক্তারের পাশে দাঁড়ান তার আত্মীয় নুরুল বশর বিপলু। তার অবস্থানের কারণে অভিযুক্ত শাহেদ-তালেব বাহিনী এই জমি দখলে নিতে পারেনি। জবরদখল কিংবা আইনিপন্থায় এই জমির দখল নিতে না পেরে তারা বিপলুর বিরুদ্ধে দিতে থাকে কিশোর গ্যাং লিডারের তকমা। বিপলুর বিরুদ্ধে পাঁচলাইশ থানা ও আদালতসহ বিভিন্ন জায়গায় দিতে থাকে একের পর এক মামলা ও অভিযোগ।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাত সাড়ে ১১টার দিকে এই জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে ছাত্রলীগ নেতা বিপলু ও আরিফের ওপর হামলা হয়। এ হামলায় আসামি করা হয় সাহেদ আলী রানা, তার ভাই তালেব আলী, রানার অনুসারী দিদারুল আলম, খোরশেদ আলম জনি ও টোকাই করিমকে। পাঁচলাইশ থানা পুলিশ ২০১৮ সালের ২২ জুলাই টোকাই করিম ছাড়া বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে এ মামলার চার্জশিট জমা দেয়।

এদিকে সাহেদ আলী রানার অনুসারী পেয়ার মোহাম্মদ সম্প্রতি নুরুল বশর বিপলুর বিরুদ্ধে আদালতে হুমকির অভিযোগ তুলে একটি মামলা দায়ের করে। এ মামলা তদন্ত করছে পিবিআই। পেয়ার মোহাম্মদ যুদ্ধাপরাধের দায়ের ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা) রাজনৈতিক ‘সহযোদ্ধা’ বলে অভিযোগ রয়েছে। সাকা চৌধুরীর সাথে রয়েছে তার বহু ছবিও স্থানীয়দের হাতে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে নুরুল বশর বিপলু বলেন, ‘সাহেদ আলী রানা, তালেব আলী ও যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ক্যাডার পেয়ার মোহাম্মদ আমার আত্মীয় রীনা আক্তারের জমি দখল করতে চাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। আমার কারণে তারা সেই জমি দখল করতে পারেনি। তারা ওই জমিতে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর করেছে। উল্টো আমার নামেই সিসিটিভি ক্যামেরা ভাঙচুর মামলা দিয়েছে। স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর মোবারক ভাইয়ের নাম বিক্রি করে তারা এই জমি দখল করতে চেয়েছিল। কিন্তু মোবারক ভাই তাদের সে সুযোগ দেয়নি। কিন্তু তারা আমার বোন রীনা আক্তার, তার স্বামী আক্তার হোসেন ও আমাকে প্রতিনিয়ত মোবারক ভাইয়ের নাম বলে বলে হুমকি দিচ্ছে।’

বিপলু আরও বলেন, ‘রানা, তালেব ও পেয়ার মোহাম্মদ সবসময় এলাকায় বলছে মোবারক ভাইকে দিয়ে আমাকে অস্ত্র মামলায় ফাঁসাবে। মোবারক ভাইকে দিয়ে তারা আমাকে নাকি র‍্যাবের মাধ্যমে ক্রসফায়ার দেওয়াবে। সম্প্রতি তালেব আলীর গাড়িতে করে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিককে ওই এলাকায় আনা হয়। সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে তার প্রমাণও রয়েছে। ওই চ্যানেলের সাংবাদিক টাকার বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধী সাকার অনুসারী পেয়ার মোহাম্মদকে সাধু সাজিয়ে তার মুখ দিয়ে আমাকে কিশোর গ্যাং লিডার, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী বলিয়েছে। অথচ আমার বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ তারা ছাড়া আর কেউ দেয়নি। তারা ওই জমি দখলে নিতে না পেরে আমাকে ফাঁসাতে এখন টাকা খরচ করছে। র‍্যাব, পুলিশ ও আদালতে অভিযোগ দেওয়ার জন্য সন্ত্রাসী রানা, পেয়ার মোহাম্মদ ও তালেব আলী এখন লোক ভাড়া করছে আমার বিরুদ্ধে। অথচ রানা ও তার অনুসারীরা আমি ও আমার বন্ধু আরিফের ওপর হামলা চালিয়েছিল ২০১৭ সালে। এ মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামী রানা, তালেব ও দিদার।’

বিপলু বলেন, ‘বিএনপির ক্যাডার হিসেবে স্বীকৃত পেয়ার মোহাম্মদ বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে টাঙানো ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে তাতে আগুন দিয়েছিল। আজকে টাকার জোরে সে আর রানা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, জমি দখলে নেমেছে।’

এ বিষয়ে অভিযুক্ত সাহেদ আলী রানা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আপনাকে আমি এভাবে বোঝাতে পারবো না। রাস্তাটা কি, এটার কি হয়েছে কি না হয়েছে সব ডকুমেন্টপত্র আপনাকে দিই। আপনি আসেন, সরাসরি কথা বলি।’ এটুকু বলেই সাহেদ আলী রানা মোবাইল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এ বিষয়ে পেয়ার মোহাম্মদ বলেন, ‘নুরুল বশর বিপলু একজন কিশোর গ্যাং লিডার। তার জ্বালায় এলাকার লোকজন অতিষ্ঠ। শাহ আমানত আবাসিকে তারা রাস্তা করতে দিচ্ছে না। মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা করা যায় না। রাস্তা যেটা একবার হয়ে গেছে সেটা জীবনেও বন্ধ করা যায় না। সাবেক কাউন্সিলর মোবারক আলীর নলেজেও সব বিষয় আছে।’

এ জমিকে চলাচলের পথ হিসেবে চেয়ে সাহেদ আলী রানার আবেদন চান্দগাঁও সার্কেল সহকারী কমিশনার (ভূমি) খারিজ দিয়েছেন— এমন তথ্য জানানো হলে পেয়ার মোহাম্মদ একপর্যায়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান।

পেয়ার মোহাম্মদ আরও বলেন, ‘বিপলু রাজনীতি করছে ক’দিন হল? বছর দুই বছর হবে। আমার সাথে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী শুধু নয়, বিএনপির কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যদি আমার কোনো ছবি কেউ দেখাতে পারে আমি জুতার মালা গলায় দিয়ে হাঁটবো।’

জমির মালিক রীনা আকতার বলেন, ‘আমার জমি রানা, তালেব, পেয়ার মোহাম্মদ দখলে নিতে চায় দীর্ঘদিন ধরে। আইনিভাবে তারা পারেনি। আমার আত্মীয় বিপলু আমার সাথে থাকায় জোর করেও তারা দখল করতে পারেনি। তাই তারা বিপলুর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিচ্ছে, অভিযোগ করছে। তারা বলে বেড়াচ্ছে র‍্যাব না হয় পুলিশকে দিয়ে তারা বিপলুকে অস্ত্র দিয়ে গ্রেফতার করাবে। বিপলুকে ক্রসফায়ার দেওয়াতে তারা টাকাও দেবে প্রয়োজনে। রানা, তালেব, পেয়ার মোহাম্মদ আমার স্বামী আকতার হোসেনের বিরুদ্ধেও কুৎসা রটাচ্ছে জমি দখল করতে না পেরে।’

রীনা আকতার আরও বলেন, ‘দখল করতে না পেরে রানা আমার জমিকে রাস্তা বানাতে চেয়ে চান্দগাঁও সহকারী কমিশনার বরাবর আবেদন করেছিল। কিন্তু কোনো কাগজপত্র তারা দেখাতে পারেনি তাদের পক্ষে। রানার আবেদন রানার বিরুদ্ধে চলে যায়। এরপর থেকে তারা বিপলু ও আমার স্বামীর বিরুদ্ধে লেগেছে। আমাকে রাস্তাঘাটে উত্যক্ত করছে। আমি পাঁচলাইশ থানায় সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী পেয়ার মোহাম্মদ ও সাহেদ আলী রানার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!