পোস্টমর্টেম/ বিশ্বকাপে জল ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টি

প্রি-প্রাইমারি বাচ্চাদের খুব পছন্দের একটি ছড়া ‘রেইন রেইন গো এওয়ে, কাম এগেইন অ্যানাদার ডে , লিটল জনি ওয়ান্টস্ টু প্লে…।’ আইসিসি চায়লে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে এটিকে ‘থিম সঙ’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে। শুধু ‘লিটল জনি’-র জায়গায় ‘অল টিম’ যোগ করতে পারে। বৃষ্টি যেভাবে আইসিসিকে চোখ রাঙাচ্ছে সেটি ছাড়া তাদের অন্য কোন পথও খোলা নেই।

বিশ্বকাপে জল ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টি? তা বলাই যায়। অনেকে রসিকতা করে বলছেন, এবার বিশ্বকাপে টুর্নামেন্ট সেরা হবেন গ্রাউন্ডসম্যানরা! অবস্থা যেদিকে গড়াচ্ছে, সে ধরনের কিছু দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বিশ্বকাপ শুরু হয়েছে দুই সপ্তাহ হলো। এরই মধ্যে রেকর্ড গড়েছে বৃষ্টি। ১৯৭৫ থেকে ২০১৫ বিশ্বকাপ পর্যন্ত মাত্র দুটি ম্যাচ যেখানে বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়েছিল, সেখানে এই বিশ্বকাপেই ১৪ দিনে পরিত্যক্ত হয়েছে ৪ ম্যাচ। ১৩ জুন ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচেই যে বৃষ্টির বাগড়ায় পণ্ড হওয়া শেষ ম্যাচ, তা কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না।
পোস্টমর্টেম/ বিশ্বকাপে জল ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টি 1
বিশ্বকাপের বাকি সময়েও বৃষ্টির বাগড়া দেওয়ার শঙ্কাই বেশি। আর তাতে প্রশ্ন উঠেছে বিশ্বকাপের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, বাজে সূচি আর পরিকল্পনার অভাব নিয়ে। এর মধ্যে দুর্বল বৃষ্টি-ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমালোচনাই হচ্ছে বেশি। আইসিসি যতই বলুক ‘জুন ইংল্যান্ডের তৃতীয় শুষ্কতম মাস’, সেখানে এ সময় বৃষ্টি হবেই বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। আর তাই বৃষ্টিতে ম্যাচ বাঁচানোর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না থাকায় তুমুল সমালোচনা হচ্ছে আয়োজনের দুর্বলতা নিয়ে।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ‘ক্রিকেটের জনক’দের মাঠ ব্যবস্থাপনা বলতে গেলে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের! অংশ নেওয়া বাকি দেশগুলোর সঙ্গে এ নিয়ে একটি তুলনাও টানা যায়। ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনাল হয়েছে জোহানেসবার্গে। সে ম্যাচে বৃষ্টি হানা দিলে দক্ষিণ আফ্রিকার এক সংবাদকর্মী জানিয়েছিলেন, যত বৃষ্টিই হোক না কেন, বৃষ্টি থামার আধঘণ্টার মধ্যে খেলা পুনরায় শুরু করার মতো ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা আছে জোহানেসবার্গে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তা–ই ঘটেছিল।

এমনকি ভারতের চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামের ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনাও অত্যাধুনিক। সেখানকার সাব-এয়ার সিস্টেম মাধ্যাকর্ষণের বলের ৩৭ গুণ বেশি গতিতে মাঠ থেকে পানি টানতে পারে। এ জন্য বৃষ্টিতে পুরো মাঠ না ঢাকলেও চলে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে। এমনকি শ্রীলঙ্কাতেও কিন্তু বৃষ্টি নামলে মাঠ পুরোপুরি ঢেকে ফেলা হয়। সে তুলনায় ইংল্যান্ডের অনেক মাঠেই ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা কিংবা সাব-এয়ার সিস্টেম নেই। বৃষ্টিতে তাদের মাঠ ব্যবস্থাপনা এখনো পড়ে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে!
পোস্টমর্টেম/ বিশ্বকাপে জল ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টি 2
বৃষ্টি যেভাবে এসে ম্যাচের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে চলছে তাতে করে দলসমূহের দীর্ঘদিনের হিসেব-নিকেশ ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম। কোন দলের বিপক্ষে কিরকম গেম প্ল্যান থাকবে, কাদেরকে কীভাবে মোকাবেলা করবে কত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ইংল্যান্ডে পা দেয় দলগুলো। কিন্তু বৃষ্টির মোকাবেলা নিয়ে কোন অসম্ভব পরিকল্পনা দলগুলোর থাকার কথা না। এটি নিয়ে যাদের মাথা ঘামানোর কথা তারা ‘নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন।’ এতে করে পয়েন্ট টেবিলের সব হিসেব-নিকেশ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকলেও ইতোমধ্যেই তাদের থেকেও বেশি পয়েন্ট সংগ্রহ করে ফেলেছে বৃষ্টি। টানা চার ম্যাচ জিতে পুরো ৮ পয়েন্ট বৃষ্টির। ভাগাভাগি হয়নি একটি পয়েন্টও। বরং প্রতিপক্ষকে বেশ নাস্তানাবুদ করেই জিতে নিয়েছে নিজের সবগুলো ইনিংস। তাইতো আইসিসির পয়েন্ট টেবিলে তার নাম না থাকলেও পায়েন্ট তালিকার শীর্ষে তারই অবস্থান।

এবারের বিশ্বকাপে বৃষ্টি তার প্রথম ম্যাচ খেলে জয় তুলে নেয় ৭ জুন। এদিন মাঠে বৃষ্টি নেমে এলে অপেক্ষাটা খুব বাড়াননি আম্পায়ার। বৃষ্টিকে খেলতে দেওয়া হয়েছিল নিজের মনের মতো করেই। তবে শেষ পর্যন্ত মাঠের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পাকিস্তান বনাম শ্রীলঙ্কার ম্যাচ পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। আর ম্যাচের দুটো পয়েন্ট নিয়ে হিসেবের খাতা খোলে ঝমঝমে বৃষ্টি।

পরবর্তীতে ১০ জুন দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ চলা অবস্থায় বৃষ্টি অনেকটা বেরসিক হয়েই হঠাৎ করে নেমে আসে সাউদ্যাম্পটনের রোজ বোল স্টেডিয়ামে। এর পরপরই বৃষ্টির কারণে সাময়িক বন্ধ রখা হয় দক্ষিণ আফ্রিকা বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ। পরে ভারী বৃষ্টি না হলেও গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টিতে উইকেট কাভারে ঢেকে রাখার সিদ্ধান্ত নেন ম্যাচ আম্পয়ার। সবশেষে বৃষ্টি পুরো দু’দলের ২২ সদস্যকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে নিজের খাতায় তুলে নেন আরো ২ পয়েন্ট।

এরপর ১১ জুন বৃষ্টি এমনভাবে মাঠ নিজের দখলে নিয়ে নেয় যে, টানা বৃষ্টির কারণে কোনো বল মাঠে গড়ানোর আগে, এমনকি টসের আগেই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার ম্যাচ। দুই দলকে পয়েন্ট ভাগ করতে হলেও মাঝ দিয়ে পুরো ২ পয়েন্টই লুফে নিয়ে যায় আদিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি। ফলে তার মোট পয়েন্ট দাঁড়ায় ছয়।

আর সবশেষ ১৩ জুন নটিংহ্যামের ট্রেন্ট ব্রিজ ক্রিকেট গ্রাউন্ডে মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল ভারত বনাম নিউজিল্যান্ডের। তবে এদিন বৃষ্টি তার প্রবলতা দেখালো বেশ করে। বাতাস ও ভেজা আউটফিল্ডের কারণে আম্পায়াররা বেশ কয়েকবার মাঠ পরিদর্শন করে ম্যাচটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন। আর এই ম্যাচে আরো ২ পয়েন্ট নিয়ে বৃষ্টি উঠে এলো আরো একধাপ উপরে।

সবমিলিয়ে পুরো চার ম্যাচে উত্তেজনাপূর্ণ খেলা খেলে ৮ পয়েন্ট নিয়ে পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে অবস্থান বৃষ্টির। এখন শুধু দেখার পালা, সে তার খেলাকে আরো গতিময় করে সামনের আরো কিছু ম্যাচ এবং সেমিফাইনাল উতরে ফাইনালে পা রাখতে পারে কি না!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইসিসিকে নিয়ে ট্রল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবার বৃষ্টির সময় বিশ্বকাপ আয়োজনের বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করলেন খোদ ইংল্যান্ডেরই সাবেক অধিনায়ক কেভিন পিটারসেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে হাস্যকর একটি ছবি পোস্ট করেছেন তিনি।
https://www.instagram.com/p/ByreSQRlhXt/
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ব্যাটসম্যান ব্যাটিং করছেন, তার পেছনে ক্যাচ ধরার অপেক্ষায় উইকেটরক্ষক। আর এই খেলাটি হচ্ছে পানির নিচে মুখে অক্সিজেন মাস্ক পড়ে। যার ক্যাপশন দেয়া হয়েছে, ‘ক্রিকেট বিশ্বকাপ ফাইনাল ২০১৯’!

বর্ষা মৌসুমে ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ আয়োজন করায় আইসিসিকে নিয়ে ট্রল করে কেউ কেউ একে বিশ্বকাপ না বলে সাঁতার কাপও বলছেন!

আইসিসির টুইটার পেজের নিচে মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান মন্তব্যের ঘরে লিখেছেন, ‘এত চমৎকার একটি ভেন্যুতে বিশ্বকাপ আয়োজন করায় আইসিসিকে ধন্যবাদ। কি দারুণ টুর্নামেন্ট।’

তার মন্তব্যের নিচে হাসির ইমোজিতে ভরে গেছে এবং সাগর ফরহাদ নামের একজন পাল্টা মন্তব্যে লিখেছেন, ‘এটা বিশ্বকাপ নয়, সাঁতার কাপ’। মন্তব্যের সঙ্গে পানির নিচে ক্রিকেট খেলার একটি ছবিও জুড়ে দেন তিনি।

‘এইরকম একটি জায়গায় বিশ্বকাপ আয়োজনের জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আইসিসিকে একটা চিঠি লিখতে চেয়েছিলাম।’ মীর সোহেল নামের একজনের হতাশা উঠে এসেছে এভাবেই। তার নিচে আরেকজন লেখেন, ‘সেটা সম্ভব না ব্রাদার।’
পোস্টমর্টেম/ বিশ্বকাপে জল ঢেলে দিচ্ছে বৃষ্টি 3
আসাদুর রহমান নামের একজন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন, ‘এটা ক্রিকেট বিশ্বকাপ, নাকি বৃষ্টি বিশ্বকাপ?’

‘ক্রিকেটের জন্য এমন সুন্দর সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করায় আইসিসিকে ধন্যবাদ।’ সাগর কাটরা নামের এক ক্রিকেট ভক্তের কথা আরও ধারালো।

আহমদ ক্রিকেটার নামের এক আইডি থেকে লেকা হয়েছে, ‘খেলোয়াড়দের বৃষ্টিতে গোসল করার জন্য একটি দুর্দান্ত সুযোগ করে দেয়ায় আইসিসি আপনাদের ধন্যবাদ।’

‘নৌকা বাইচ আয়োজনের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা।’ জিতিন কে জনি লিখেছেন এমনই।

আইসিসিকে বাতলে দেয়া বালাজির বুদ্ধি তো আরও মজার, ‘সব ম্যাচ বাতিল করে, ট্রফিটা টুকরো টুকরো করে সবদলের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হোক।’ নিচেই একজন শিরোপাজয়ী ঘোষণা করেছেন, ‘বিশ্বকাপ জেতার জন্য বৃষ্টিকে অভিনন্দন।’

রিজওয়ান আহমেদের কথাতেও এসেছে সাঁতার প্রসঙ্গ, ‘ক্রিকেটের পরিবর্তে সেখানে একটা সাঁতার বিশ্বকাপ আয়োজন করা যেতে পারে। আর যে দলের অধিনায়ক ১৪ জুলাই পর্যন্ত সাঁতারে বেশি সময় টিকে থাকার ক্ষমতা দেখাতে পারবেন, তারাই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবেন।’

‘ভয়ানক দেশ, ভয়ঙ্কর আবহাওয়া’ -ক্ষুব্ধ আরেকজন লিখেছেন এমনই। জয়াবর্ধনে নামের একজন বৃষ্টি সংক্রান্ত খবরের শিরোনামই ঠিক করে দিয়েছেন, ‘আমাদের বিশ্বের সেরা নিষ্কাশন ব্যবস্থা আছে: ইসিবি।’-বিশ্লেষণটি ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অবলম্বনে লিখিত।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!