ডেঙ্গু সারতেই মানসিক অবসাদের ধকল, রোগী বাড়ছে চট্টগ্রাম মেডিকেলের আউটডোরে
কাউন্সেলিং জরুরি, বলছেন ডাক্তাররা
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠা বেশিরভাগ রোগী ‘পোস্ট ডেঙ্গু অ্যাস্থেনিয়া’ বা মানসিক অবসাদে ভুগছেন। সুস্থ হওয়ার পরও শারীরিক দুর্বলতা, ক্লান্তি, অবসাদ ঘিরে ধরছে তাদের। এতে রোগী স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও নানা ধকলের সম্মুখীন হচ্ছেন। হাসপাতালে প্রতিদিনই গড়ে ৫০ জন রোগী শরণাপন্ন হচ্ছেন ডাক্তারের।
বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত সময়ে মানসিক যে ধকল যায়, এতে রোগীর স্থিতিশীল হতে সময় লাগে। অনেকে ধকল সামালে গিয়ে প্যানিক অ্যাটাকের পড়ে। সুস্থ হওয়ার পরও মনে একটা আতংক তৈরি হয়। তাই এই ধরনের রোগীদের ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি দরকার কাউন্সেলিং।
ডেঙ্গুর পর যে কেউই পোস্ট ডেঙ্গু অ্যাসথেনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে নারী, শিশু ও বয়স্কদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে জানান ডাক্তাররা।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১৮০ থেকে ২০০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে এখন প্রায় ৫০ জনের বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে যারা ডেঙ্গু পরবর্তী জটিলতার চিকিৎসা নিতে আসছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের রোগীর চাইতে বড় একটা অংশ বাড়ি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু ডেঙ্গু পরবর্তী অবসাদ নিয়ে সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগে এবং ডাক্তারের ব্যক্তিগত চেম্বারে যাচ্ছেন বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে। এদের অতিরিক্ত দুর্বলতা, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, মনোযোগহীনতা, খাবারে অরুচি, মাথা ঘোরানো, নিদ্রাহীনতা অথবা অতি নিদ্রার মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। অনেকে সুস্থ হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরও স্বাভাবিক কাজ বা চাকরিতে ফিরে যাওয়ার মনোবল পাচ্ছে না। অনেকে আবার সকাল-বিকাল টানা ঘুমাচ্ছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগে কথা হয় নোমান আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি অনার্স ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী।
নোমান জানান, ডেঙ্গুতে সেরে ওঠার পর তার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে ওঠেন। চোখে-মুখে অন্ধকার লাগে। ডাক্তার দেখিয়েছেন, ডাক্তার পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকতে বলেছেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. পঞ্চানন আচার্য চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এই সময়কে Convalescent period বলে। এই সময় ধীরে ধীরে শরীর ও মন পুনর্গঠন হয়, এতে সপ্তাহখানেক বা কারও ক্ষেত্রে মাসখানেকও সময় লাগতে পারে। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, কিডনি, শ্বাসরোগ বা অন্য কোনো রোগ থাকে, তাদের বেলায় কিছু বেশি সময় ধরে চলে। শরীর পরিপূর্ণভাবে গড়ে ওঠে বলে এই সময়ে কাজের মাত্রা বা চাপ তাড়াতাড়ি আগের মতো বাড়ানো ঠিক না, বাড়াতে হবে ধীরে ধীরে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আমরা সাইকোলোজিক্যাল কোনো সমস্যাকে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো সমস্যা মনে করি না। ডেঙ্গু পরবর্তী যে মানসিক অবসাদগ্রস্ততার শিকার হচ্ছেন রোগীরা, তার চিকিৎসা নিতে মানসিক ওয়ার্ডে কম আসছে। আসলেও সেটি হাতেগোনা। মেডিসিন ট্রিটমেন্টেই তারা প্রেফার করছে। কিন্তু এ সমস্যায় ঔষুধের পাশাপাশি মানসিক কাউন্সেলিং জরুরি। মেডিসিন বহির্বিভাগ থেকেই রোগীদের মানসিক ওয়ার্ডে রেফার্ড করতে হবে ডাক্তারদের।’
ডা. পঞ্চানন আচার্য বলেন, ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর রোগী দুর্বল থাকে, অবসাদগ্রস্ত থাকে। চলাফেরার সময় কিছু ভারসাম্যহীনতা থাকে, নিবিড়ভাবে কাজে মনোনিবেশ করা যায় না। তবে সপ্তাহ দুয়েক পর রোগীর শারীরিক ও মানসিক কাজ করার ক্ষমতা আগের মতোই ফিরে আসবে। তাই ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর শিথিলতার সঙ্গে দু-তিন সপ্তাহ কাটাতে হবে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন বহির্বিভাগের রেসিডেন্ট ফিজিশিয়ান (আরপি) ডা. সাহেদ উদ্দিন বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতা, রক্তে লবণের মাত্রা কমে যাওয়া, থাইরয়েড, যকৃত, কিডনি ইত্যাদির সমস্যা আছে কি-না খুঁজে দেখতে হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিমিত তরল খাবার খেতে হবে। রোগ থেকে উঠেই অতিরিক্ত পরিশ্রম শুরু করা যাবে না। পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। ডেঙ্গু থেকে সেরে উঠেই দীর্ঘ পথে যাত্রা করা উচিত নয়। কোনো দুশ্চিন্তা করা যাবে না।’
ডিজে