কাতার থেকে চট্টগ্রামে চাঁদাবাজির জাল সরওয়ার-ম্যাক্সনের

কাতার ও ভারতে বসেই চাঁদাবাজির জাল বিস্তার করেছেন শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ, ম্যাক্সন ও সরওয়ার। পরে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন যুবলীগ ক্যাডার একরাম। চট্টগ্রামের আদালতে অস্ত্রমামলায় সাজা পাওয়া শিবির ক্যাডার মো. সরওয়ার ওরফে বাবলা এবং নুরনবী ওরফে ম্যাক্সন গেল বছরের শেষ দিকে কাতারে মারামারিতে জড়িয়ে কাতার পুলিশের হাতে আটক হন। কাতারপ্রবাসী একটি সূত্রের মতে, গত ২৯ ডিসেম্বর রাতে সরওয়ারকে এবং ৩০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ৩টার দিকে ম্যাক্সনকে গ্রেপ্তার করে কাতারের পুলিশ। এরপর কাতার পুলিশ সরওয়ারকে দেশে ফেরত পাঠালে শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টায় ঢাকা নগর পুলিশের বিমানবন্দর থানা আটক করে। খবর পেয়ে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার একটা টিম সরওয়ারকে চট্টগ্রাম আনার জন্য ঢাকা যান। সরওয়ার ও ম্যাক্সন আলোচিত ‘এইট মার্ডার’ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি সাজ্জাদ আলীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

বায়েজিদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রিটন সরকার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে সরওয়ারের বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাস, ডাকাতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ১৬টি মামলার নথি পাওয়া গেছে।

সরওয়ার ও ম্যাক্সনকে ২০১১ সালের ৪ জুলাই রাতে ম্যাক্সনের শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের সিঙ্গার বিল থেকে আটক করেছিল নগরীর বায়েজিদ থানা পুলিশ। তাদের দেওয়া তথ্যে একে-৪৭ রাইফেলসহ ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, একে-৪৭ রাইফেলের দুটি ম্যাগজিন ও ২৭ রাউন্ড গুলি এবং বিদেশি পিস্তলের একটি ম্যাগজিন ও তিন রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। আটক হয়েছিল তাদের আরেক সহযোগী মানিক প্রকাশ গিট্টু মানিক।

তদন্ত শেষে একই বছরের ৮ আগস্ট আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। ২০১২ সালের ২৬ জানুয়ারি তিন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এই মামলার বিচার শুরু হয়। ১১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট ওই অস্ত্র মামলায় সরওয়ার ও ম্যাক্সনের উপস্থিতিতে তিন সন্ত্রাসীকে ২১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত।

এক বছর জেল খাটার পর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে তারা কারাগার থেকে ছাড়া পান। একপর্যায়ে দেশত্যাগ করেন। দেশত্যাগ করলেও তাদের ‘গুরু’ সাজ্জাদ আলীর হয়ে চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেন বিদেশ থেকেই। বায়েজিদ-পাঁচলাইশ এলাকায় গড়ে ওঠে তাদের তিনটি বাহিনী। কেউ নতুন বাড়ি-ঘর কিংবা ব্যবসায় বাণিজ্য করতে লেহ তাদের চাঁদা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের দুজন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে তাদের হয়রানি করার পর চট্টগ্রামের ওয়াজেদিয়া এলাকা থেকে ২৪ অক্টোবর রাতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ওই পাঁচ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে বায়েজিদ থানার পুলিশ। ওই সময় নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (বায়েজিদ বোস্তামি জোন) পরিত্রাণ তালুকদার জানান, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা দাবির সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে শিবির ক্যাডার সরওয়ার ও ম্যাক্সন এবং কথিত যুবলীগ নেতা একরামের বিষয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এতে উঠে আসে, তারা কাতারে বসে তারা সন্ত্রাসীদের দিয়ে চট্টগ্রাম শহরে চাঁদাবাজি করাচ্ছে।

এছাড়া উজ্জ্বল দেওয়ানজী নামে অপর এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের নামে টাকা দাবির মৌখিক অভিযোগ পায় পুলিশ। এ অভিযোগের তদন্তে নেমেও পুলিশ জানতে পারে, সরোয়ার, ম্যাক্সন ও একরাম কাতারে অবস্থান করে গ্রেফতার রুহুল আমিনের মাধ্যমে উজ্জ্বলের কাছ থেকে টাকা চেয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে আছে জমি দখলের অভিযোগও। বিভিন্ন সময় ভুক্তভোগীরা থানায় সাধারণ অভিযোগও করেছেন। এক অভিযোগের ভিত্তিতে গেল বছর ২৪ অক্টোবর রাতে আগ্নেয়াস্ত্রসহ পাঁচ সন্ত্রাসী— রুহুল আমিন (২১), মো. তুহিন (২৮), সুজন (২৯) জাবেদ ওরফে ভাগিনা জাবেদ (৩১) ও রনিকে (২০) আটক করে পুলিশ। এর আগে চাঁদা না দেওয়ায় ২৩ সেপ্টেম্বর নয়াহাটে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে পেট্রোল বোমাও নিক্ষেপ করেছিল তারা। শুধু ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি নয়, গত বছর সরওয়ারের অনুসারীরা অক্সিজেন এলাকায় একটা মন্দিরের জায়গা দখলে নিতে হামলা চালায়। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের তারা পিছু হটে।

পাঁচলাইশ ওয়ার্ডের পূর্ব শহীদ নগর এলাকার এক কাতারপ্রবাসীর বাড়ি নির্মাণ কাজে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের নাম দিয়ে মোবাইলে চাঁদা দাবি করা হয়। সাজ্জাদ ভারত থেকে বাড়িওয়ালাকে বলেন, তার দুই অনুসারী ম্যাক্সন ও সরওয়ার কাতারে অবস্থান করছে। তাদের কাতারে আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে। ওই কাতারপ্রবাসী চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কালা মানিক নামে তাদের অপর এক সহযোগী ফোন দিয়ে তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেয়। ওই কাতার প্রবাসী ব্যবসায়ী দেশে আসলে সাজ্জাদের সহযোগী নাজিম উদ্দিন হিরু, গিয়াস উদ্দিন ও নজরুল ইসলাম মুন্না নামের তিন সন্ত্রাসী কাতারে পলাতক থাকা ম্যাক্সন ও সরওয়ারকে আশ্রয় ও আর্থিক সহায়তা করার জন্য চাপ দেয়।

তবে সরেজমিনে এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, অধিকাংশ ব্যবসায়ী, বাড়িওয়ালা ভয়ে মুখ না খুলে নীরবে চাঁদা পরিশোধ করেন। শুধু মুরাদপুর এলাকার গাড়ির খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ীরা প্রতি মাসে ২০ লাখ টাকা দেয় ভারতে পালিয়ে থাকা সাজ্জাদের জন্য। যা সরওয়ার ও ম্যাক্সনের অনুসারীরা সংগ্রহ করে।

এফএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!