৪ বছর ধরে তালা ঝুলছে দেশের একমাত্র রেল জাদুঘরে (ভিডিওসহ)

নষ্ট হচ্ছে অমূল্য নিদর্শন

চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে রয়েছে দেশের একমাত্র জাদুঘর ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে জাদুঘর’। সেখানে শতবর্ষের পুরনো রেলওয়ের ঐতিহ্য, পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই জাদুঘরটির দরজায় প্রায় ৪ বছর ধরে তালা লাগানো। অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে জাদুঘরের নিদর্শনগুলো।

বাংলাদেশ রেলওয়ে কেরিজ ও ওয়াগন কারখানার সম্মুখে প্রায় ১২ একর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে জাদুঘরটি অবস্থিত। জাদুঘরের কাঠের তৈরি দোতলা বাংলোটি প্রায় ৪২০০ বর্গফুট এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। ২০০৩ সালের ১৫ নভেম্বর দেশের একমাত্র রেলওয়ে জাদুঘরে পরিণত হবার আগ পর্যন্ত এটি রেলওয়ের বাংলো হিসেবে ব্যবহৃত হত। ২০১৬ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জাদুঘরটির সংস্কার কাজ শুরু করে। অথচ সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার পরেও জাদুঘরটি খোলা হচ্ছে না।

জাদুঘরের বর্তমান অবস্থা
জাদুঘরের দরজায় ঝুলে আছে তালা। নেই কোনো দর্শনার্থীর আনাগোনা। অনুমতি নিয়ে জাদুঘরের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, সকল নিদর্শন ধুলাবালিতে একাকার। ধুলাবালির কারণে নিদর্শনগুলো চেনাই মুশকিল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নিদর্শনগুলো। অনেক নিদর্শন ভেঙে পড়ে আছে।

জাদুঘরে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্ববর্তী সংস্থা আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে (১৯৪২), ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (১৯৪৭) এবং পাকিস্তান রেলওয়ে (১৯৬১) কর্তৃক ব্যবহৃত বিভিন্ন নিদর্শন এবং বস্তুর সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে। সংরক্ষিত শিল্পকর্মগুলো প্রধানত বাংলাদেশ রেলওয়ের যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক, টেলিযোগাযোগ, সংকেত, ট্রাফিক ও প্রকৌশল বিভাগের অন্তর্গত। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের বাতি ও আলো, পাকা ও ঘন্টা, স্টেশন মাস্টারের পোশাক এবং আনুষাঙ্গিক, সিগন্যাল সরঞ্জাম, ট্রান্সমিটার, অ্যানালগ টেলিফোন, মনোগ্রাম, ট্র্যাক সুইচ এবং রেলওয়ে স্লিপার রয়েছে জাদুঘরের সংরক্ষণে।

জানা গেছে, জাদুঘরের পিছনে রয়েছে পাঁচ শতাধিক অবৈধ স্থাপনা। সীমানাও নেই। পাশেই গড়ে উঠেছে নুরুল ইসলাম মোল্লা নামের এক ব্যক্তির শাহ আমানত নামের একটি ডেইরি ফার্ম।

জাদুঘরটিতে তিনজন দারোয়ান রয়েছে। তারাই এই জাদুঘরটির দেখাশোনো করে আসছেন অনেক বছর ধরে। কিন্তু তিনজনের পক্ষে এই জাদুঘরটি পাহারা দেওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।

ধুলাবালির কারণে নিদর্শনগুলো চেনাই মুশকিল। অনেক নিদর্শন ভেঙে পড়ে আছে।
ধুলাবালির কারণে নিদর্শনগুলো চেনাই মুশকিল। অনেক নিদর্শন ভেঙে পড়ে আছে।

প্রহরী জামাল বললেন, আমরা তিনজনের মধ্যে একজন দিনে পাহারা দেই এবং দুইজন রাতে। কিন্তু লোকবল দরকার ছয়জন। কারণ এখানে আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। দিন রাতে বখাটে ছেলেদের উৎপাত বাড়ছে। রাত হলে তো মদ, গাজা, জুয়া এবং নানারকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে এর আশেপাশে। দিনের বেলায় মেয়েদের উত্যক্ত করা হয়। তাদের বাধা দেওয়ার মতো সাহস আমাদের নেই। তাদের বাধা দিতে গেলেই আমাদের হুমকি দেয়।

প্রহরীরা জানান, বর্তমানে সম্পূর্ণ অরক্ষিত রয়েছে এই জাদুঘরটি। সীমানা প্রাচীর দেওয়া থাকলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে নেই কোনো সীমানা প্রাচীর। তাই আমরা চাই লোকবল যাতে আরো বাড়ানো হয়।

জাদুঘরে ঘুরতে আসা ফরিদ নামের এক ব্যক্তি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, জাদুঘরটি সমগ্র বাংলাদেশ রেলের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস, কৃষ্টির ধারক ও বাহক। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই জাদুঘরটি হয়ে উঠতে পারে জ্ঞানের উৎস। কিন্তু এই জাদুঘরটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পথে। চার বছর ধরে তালা ঝুলে আছে। ছুটির দিনে আশেপাশে ঘুরি। খুবই ইচ্ছে করে বাচ্চাদের এই জাদুঘরে ঘোরাতে। কিন্তু কী আর করা!

অপর একজন বলেন, কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর গাফিলতির কারণে বন্ধ হয়ে আছে এটি। এইভাবেই আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য চিরতরে মুছে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের উচিত এইসব ইতিহাস ঐতিহ্য ধরে রাখা।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জাদুঘরটির সংস্কার কাজ শুরু করে। এই কারণে চার বছর ধরে এই জাদুঘরটি বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন জাদুঘরের সংস্কার কাজ শেষ। এরপর কেন খোলা হচ্ছে না— কেউ তা জানে না। এই জাদুঘরটি আদৌ আবার খোলা হবে কিনা তা নিয়েও অনেকের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাহাড়তলীর রেলওয়ে বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আব্দুল হানিফ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সংস্কারের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু জাদুঘরটি এখনো ঘুরে দেখা হয়নি— বর্তমান চিত্রটি কেমন। ঘুরে দেখেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রেলওয়ের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আমির হোসেন বলেন, ‘আমি এসেছি মাত্র এক বছর হয়েছে। জাদুঘর সংস্কারের কাজ ২০১৬ সালেই শুরু হয়েছে। তবে ঠিকাদার কাজ সম্পন্ন করে বুঝিয়ে দিয়েছে। অতি শীঘ্রই আমরা জাদুঘর আবার চালু করবো। তবে কখন চালু করতে পারি এ বিষয়ে এখন কিছু বলতে পারছি না।’

এছাড়া রেলওয়ে জাদুঘরের পাশে শেখ রাসেল স্মৃতি শিশুপার্ক তৈরি হচ্ছে। ওই শিশু পার্কটি চালু হলে জাদুঘরটি খোলা থাকবে নাকি বন্ধ হয়ে যাবে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!