৩৯ বছরে ১৯ বার ঘাতকের টার্গেটে শেখ হাসিনা

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঘাতকচক্রের ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলা থেকে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিনের সেই ঘাতকচক্র ও নেপথ্য কুশীলবরা এখনও সক্রিয়। গ্রেনেড হামলার পর ১৬ বছরেও এখনও ঘাতকের টার্গেট হয়ে আছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার পরও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উদ্বিগ্ন হলেও ভীত নন। তিনি বহুবার বলেছেন, ‘আমার বাবা-মাকে খুন করা হয়েছে। হয়তো আমাকেও খুন করা হবে। তবে জীবন দেওয়া ও নেওয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহ। মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে মানুষের দোয়ায় বারবার বেঁচে গেছি।’

বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ কয়েক দফায় নিজের প্রাণনাশের অপচেষ্টার ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমার পরিণতি বাবার মতো হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে আমাকে মাইনাসের চেষ্টা হয়েছিল। জানি না, আল্লাহ কোন ইচ্ছায় আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’

শেখ হাসিনার জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে বরাবরই উৎকণ্ঠা রয়েছে। বিরোধী দলে থাকাকালে নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছিল। বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল বুলেটপ্রুফ গাড়ি। কিন্তু সেই নিরাপত্তা বেষ্টনীও টেকেনি। নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ গ্রেনেড হামলার ঘটনায় শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন দিয়ে গেছেন।

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দৃষ্টিতে নানা কারণে বারবার মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এগুলো হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার ও রায় কার্যকর, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু এবং ফাঁসির দণ্ড কার্যকর, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির মূলোৎপাটন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র।

শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে নারকীয় গ্রেনেড হামলা হয়েছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে শেখ হাসিনার ভাষণ শেষ হওয়ার পর মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে শহীদ হন ২৪ নেতাকর্মী। অলৌকিভাবে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।

মৃত্যুর ওই আঙিনায় দাঁড়িয়ে সবার একটিই জিজ্ঞাসা ছিল— ‘শেখ হাসিনা কোথায়? বেঁচে আছেন তো!’ খানিক পরই যেন কানে এলো দৈববাণী— ‘মৃত্যুজাল ছিন্ন করে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।’

স্মরণকালের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলায় স্প্রিন্টারের আঘাতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়েছিল শত শত মানুষ, ছিল প্রাণহীন নিথর শরীর। এই গ্রেনেড হামলায় চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪টি তাজা প্রাণ। খোলা ট্রাকমঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়ে নেমে এসে শান্তি মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতির সময় বিকট শব্দে একের পর এক বিস্ফোরিত হয় ১৩টি তাজা গ্রেনেড।

আওয়ামী লীগ সভাপতির বুলেটপ্রুফ গাড়ি লক্ষ্য করে ছুটে আসে ১২টি গুলি। আর এতেই আওয়ামী লীগ অফিসের চারপাশে যেন রক্তগঙ্গা বয়ে যায়। খানিক আগের জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে। রক্তে লাল হয়ে যায় পিচঢালা কালো রাজপথ। বীভৎস ওই গণহত্যার পরমুহূর্তে ঘটনাস্থলে হাত-পাসহ মানবদেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল।

হত্যাচেষ্টা একের পর এক
১৯৮১ সালে দেশে আসার পর থেকে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক জঙ্গি অপশক্তি কমপক্ষে ১৯ বার শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা চালিয়েছে।

১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী অবরোধ চলাকালে সচিবালয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলে শহীদ হন যুবলীগ কর্মী নূর হোসেন।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামেও হত্যার চেষ্টা হয়। ওই দিন আওয়ামী লীগ সভাপতির গাড়িবহরে গুলি করা হলে শহীদ হন ২৪ নেতাকর্মী।

একই বছরের ১৫ আগস্ট ও ১৯৮৯ সালের ১১ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির কর্মীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে।

১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ধানমণ্ডির গ্রিন রোডে পরিবার পরিকল্পনা ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনকালে গুলিবর্ষণ করা হলে প্রাণে বাঁচেন শেখ হাসিনা।

১৯৯৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাবনার ঈশ্বরদীতে হত্যার চেষ্টা হয়। ট্রেনে গুলিবর্ষণের পর তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে তিনি প্রাণে বাঁচেন।

১৯৯৫ সালের ৭ ডিসেম্বর রাসেল স্কোয়ারে আওয়ামী লীগের জনসভায় বোমা হামলার সময় নেতাকর্মীরা শেখ হাসিনাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন।

১৯৯৬ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল থেকে অস্ত্রধারীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।

২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভার কাছে পুঁতে রাখা হয় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা; কিন্তু আগেই বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ায় রক্ষা পান প্রধানমন্ত্রী।

২০০১ সালের ২৯ মে খুলনার রূপসা সেতু এলাকায় যাওয়ার কথা ছিল শেখ হাসিনার। ঘাতক চক্র সেখানে শক্তিশালী বোমা পুঁতে রেখেছিল।

২০০২ সালের ৪ মার্চ নওগাঁয় বিএমসি সরকারি মহিলা কলেজের সামনে শেখ হাসিনার গাড়িতে হামলা চালানো হয়।

২০০৩ সালের ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় গাড়িবহরে গুলিবর্ষণের ঘটনায় প্রাণে বাঁচেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে ঘাতকের বুলেট থেকে তিনি রক্ষা পান।

একই বছরের ২১ আগস্ট তাকে হত্যার উদ্দেশে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গ্রেনেড হামলা করা হয়। এতে ২৪ জন নিহত হন।

সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই অন্যায়ভাবে বিনা ওয়ারেন্টে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে সাব-জেলে রেখে বিষক্রিয়ার মাধ্যমে হত্যার অপচেষ্টা হয়েছিল।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের সময়ও তৎকালীন মহাজোট সরকারকে উৎখাত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার টার্গেট করা হয়েছিল।

শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ২০১১ সালে শ্রীলংকার একটি সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রুরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী চক্র চুক্তি করে। এজন্য সুইসাইড স্কোয়াডও গঠন করা হয়। এই মিশন সফল করতে আগাম অর্থও দেয়া হয়।

২০১২ সালে সেনাবাহিনীতে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থান পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফের ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করা তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অভ্যুত্থানের প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ হাসিনা।

২০১৪ সালের শেষে দিকে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং অভ্যুত্থানের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতার জঙ্গি শাহানুর আলম ওরফে ডাক্তার।

২০১৫ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাওয়ার পথে কারওয়ান বাজারে তার গাড়িবহরে বোমা হামলা চালানোর চেষ্টা চালায় জেএমবি।

২০১৮-১৯ সালে কয়েকবার তাকে বহনকারী বিমানে ত্রুটি ধরা পড়ে। এগুলোও হত্যা চেষ্টা বা হত্যা ষড়যন্ত্র বলে মনে করা হয়ে থাকে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!