তেত্রিশের তফাৎ/ আত্মহত্যায় ‘মুক্তি’ খুঁজে নিল বাল্যবধূ মুমু

জেএসসি পাস করে পরিবারের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল ১৫ বছরের কিশোরী আফরোজা খানম মুমু। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার আধুনগর এলাকার ৪৮ বছর বয়সী শফিকুর রহমান শফির সঙ্গে বিয়েও হয়ে যায় তার ঘটা করে। বিয়ের দেড় মাস পর স্বামীকে ভালো করে চেনার আগেই বিদেশে চলে যান শফি। স্বামী বিদেশ চলে যাওয়ার পর মুমু নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয় স্থানীয় হাজী সামশুল ইসলাম উচ্চ বিদ্যালয়ে।

মুমুর সঙ্গে স্কুলে পড়তো স্বামীর বোনের ছেলে একই এলাকার মো. হারুন। স্বামী শফি বিদেশ চলে যাওয়ার পর তার ভাগ্নে হারুনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মুমুর। বিষয়টি দুই পরিবারের মধ্যে জানাজানি হলে সামাজিক বৈঠকের মাধ্যমে বিদেশে থাকা স্বামী শফিকুর দেশে চলে আসেন। সামাজিক বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর স্বামী আবারও বিদেশ চলে যান। এরপর শ্বশুরবাড়ির লোকজন তাকে নির্যাতন শুরু করে।

গত ১৫ মে মুমুর পরিবারকে ডেকে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হলে পরের দিন (১৬ মে) সকালে সবার অজান্তে বিষপান করে মুমু। পাঁচদিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে মঙ্গলবার (২১ মে) বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যায় সে। মুমুর আত্মহত্যার পর গা ঢাকা দিয়েছে দুই পরিবারই।

জানা যায়, ঘটনার আগের দিন মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে মুমুর বাবা-মা বেড়াতে আসেন। ওই দিন এসব বিষয় নিয়ে মা-মেয়ের মধ্যে কথা কথাকাটি হয়। পরে সবার অজান্তে সকালে বিষ পান করে গৃহবধূ মুমু। পরে আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়। চমেক হাসপাতালে পাঁচদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়।

এদিকে মুমুর মৃত্যুর পর আইনের ফাঁকফোকর থেকে বাঁচতে দুই পরিবারের লোকজন এক ধরনের গা ঢাকা দিয়েছে।

বাল্যবিয়ের বিষয়টি জানতেন না আধুনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আইয়ুব মিয়া – এমনটি দাবি করে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মুমুর সঙ্গে আধুনগর ইউনিয়নের শফিকুর রহমানের যখন বিয়ে হয়, তখন তারা আমাকে বিষয়টি জানায়নি। আমার ইউনিয়নে পঞ্চাশ হাজার লোক বসবাস করে। তারা যদি আমাকে না জানায়, আমি কিভাবে জানবো?’

বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন বলা হয়েছে, কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির উপর কর্তৃত্ব সম্পন্ন হয়ে তাদের পিতা-মাতা, অভিভাবক, অন্য কোন ব্যক্তি, আইনগত বা আইনবহির্ভূত হয়ে বাল্যবিবাহ অনুমতি বা সম্পাদন অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিবাহ বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য দুই বছর অথবা ৬ মাস বা ৫০ হাজার জরিমানা গুণতে হবে বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবে। এছাড়া জরিমানা অনাদায়ে আরও ৩ মাসের কারাভোগের বিধানও রয়েছে।

এদিকে মুমুর বয়স ১৫ আর শফির বয়স ৪৮ বছর – এ বিষয়টি জেনেও কেন বিয়ে নিবন্ধন করলেন জানতে চাইলে ওই এলাকার সরকারি নিবন্ধনভুক্ত কাজী মাওলানা নাসির উদ্দীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এ ধরনের কোন বিয়ের কাজ করিনি। আফরোজা খানমের ঘটনা শুনেছি। কিন্তু কারা বিয়েটি সম্পাদন করেছে, তা আমার জানা নেই।’

মুমুর আত্মহত্যা মেনে নিতে পারছেন না তার সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠজনরা। সহপাঠীর মৃত্যুতে তার ক্লাসের শিক্ষার্থীরা বাকরুদ্ধ। ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন রাখলেন অনেকেই – প্রশাসন ও স্থানীয় প্রতিনিধি এবং বিয়ে পড়ানো কাজী কি আইন জানেন না, নাকি মানেন না?

অকালে চলে যাওয়া আফরোজা খানম মুমুর ক্লাসের সহপাঠীদের অনেকেই চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, মুমুর মতো আর কাউকে যেন মরতে না হয়। আমরা মুমুর মতো আর কাউকে হারাতে চাই না। যারা মুমুর জীবনে এমন পরিণতি ঘটিয়েছে তাদের সকলকেই আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দাবিও করেন তারা।

জানতে চাইলে লোহাগাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিক আহমদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘মুমুর ঘটনার সময় আমি এখানকার দায়িত্বে ছিলাম না। আরেকজন ছিলেন।’ যারাই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যাবে বলে পরামর্শ দেন ইউএনও।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!