সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে লাশ হয়ে ফিরেছে ১ বছরে

চিকিৎসায় দেরি ও এইচডিইউর অভাবে মুমূর্ষু রোগী বাঁচে না

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত এক বছরে চিকিৎসা দিতে দেরি ও হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) অপ্রতুলতার কারণে মারা গেছে প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার মুমূর্ষু রোগী। মূলত ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার (ওসেক) চালুর পরও রোগীকে চিকিৎসা দিতে সময়ক্ষেপণের কারণে রোগী মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে।

এছাড়া চট্টগ্রাম মেডিকেলের কিছু ওয়ার্ডে এইচডিইউ থাকলেও তাতে নেই কম্পিউটার মনিটর ও পর্যাপ্ত ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা। ফলে সময়মতো উন্নত পরিচর্যা পাচ্ছে না রোগী। এতে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ১৭ হাজার ৫২০ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ চিকিৎসা দিতে দেরি হওয়ার কারণে এবং এইচডিইউর অভাবে মারা গেছে।

অথচ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) ঠিক আগের স্তর এইচডিইউ। সঙ্কটজনক রোগীদের চিকিৎসা ও পর্যবেক্ষণে রাখা হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই ইউনিটে।

কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেলের এইচডিইউতে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। এখানকার এইচডিইউ ইউনিটগুলোতে কাঁচঘেরা ঘর থাকলেও বেডের সামনে থাকা কম্পিউটার মনিটর নষ্ট। অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো খালি পড়ে আছে বেডের পাশে। হাসপাতালে ওয়ার্ড মাস্টার, ওয়ার্ডবয় এবং সর্দার ‘টাকা খেয়ে’ এসব কাঁচঘেরা বেড রোগীদের ব্যবস্থা করে দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

একই রকম চিত্র দেখা গেছে হাসপাতালের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে। মুমূর্ষু রোগীর বদলে সাধারণ রোগীদের রাখা হয়েছে ওয়ার্ডের কাঁচঘেরা দুই এইচডিইউ ইউনিটে।

সোমবার (২ জানুয়ারি) দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেলের সিসিইউ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ওয়ার্ডের মেঝেতে সাজ্জাদ হোসেনের নামের এক যুবকের লাশ চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে আনোয়ারার বাসিন্দা সাজ্জাদের।

সাজ্জাদের স্বজনরা জানান, সাজ্জাদ হোসেনের মাঝে মাঝে বুকে ব্যথা হতো। সোমবার সকালে তীব্র ব্যথায় অজ্ঞান হয়ে গেলে প্রথমে আনোয়ারা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানের কর্তব্যরত ডাক্তার রোগীকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন।

হাসপাতালে নিয়ে আসার পর সাজ্জাদকে ১২ নম্বর হৃদরোগ ওয়ার্ডের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। হার্টঅ্যাটাক হওয়ায় তাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়। ওষুধ ও ইনজেকশন পেয়ে কিছুটা সুস্থতা অনুভব করলেও পরে পোস্ট করোনারি ইউনিটে পাঠানো হয় তাকে। সেখানে পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই সাজ্জাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। পরে আবারও তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হলে খিঁচুনি উঠে দুপুর আড়াইটার দিকে মারা যায় সাজ্জাদ।

জানা গেছে, হার্টঅ্যাটাকে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগী তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পান না। তাদের মূলত ‘এসটিকে’ ইনজেকশন দেওয়া হয়। কিন্তু হাসপাতাল থেকে এই ইনজেকশনের সরবরাহ না থাকায় প্রায় ৪ হাজার টাকা খরচ করে এটি বাইরের দোকান থেকে কিনতে হয় রোগীর স্বজনদের। এছাড়া আরও ওষুধপত্রসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা খরচ পড়ে। কিন্তু এমন সঙ্কটের মুহূর্তে অনেকে টাকার জন্য ঠিকমতো ওষুধও কিনতে পারেন না।

সাজ্জাদের মৃত্যুর বিষয়ে হৃদরোগে ওয়ার্ডের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. লক্ষ্মীপদ দাশ বলেন, ‘হার্টঅ্যাটাক রোগীকে অন্তত তিনদিন আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা উচিত। কিন্তু আইসিইউতে বেড রয়েছে মাত্র ১৬টি। এখানে ফ্লোরে চিকিৎসা দেওয়া হয় আরও ১৬ জনকে। মোট ৩২ জনের বেশি রোগীকে আইসিইউ ইউনিটে রাখা সম্ভব হয় না। আইসিইউতে ভর্তির পর কোনো রোগী যদি সুস্থতা অনুভব করে তখন তাকে পোষ্ট সিসিইউতে পাঠানো হয়।’

এইচডিইউ ইউনিট সম্পর্কে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের এক ডাক্তার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘মূলত এইচডিইউ ইউনিটে লজিস্টিক সাপোর্ট থাকলে মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচানো সম্ভব হত। এই ইউনিটের কম্পিউটার মনিটর নষ্ট, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট নেই; শীতাতপ নিয়ন্ত্রিতও নয়। বাধ্য হয়ে মুমূর্ষু রোগীদের সাধারণ ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দিতে হয়। ফলে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!