টাকার লোভ/ অতিরিক্ত খাল কেটে সড়কের সর্বনাশ করলো সাইফ পাওয়ারটেক

বেশি বিলের আশায় অতিরিক্ত খাল খনন করায় টানা বৃষ্টির পানিতে চট্টগ্রামের খতিবেরহাট সড়কের দীর্ঘ গার্ডওয়ালের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে দেয়ালটি ধসে ভেঙে পড়েছে। পাঁচলাইশ থানার ৭ নম্বর ওয়ার্ড খতিবেরহাট এলাকায় মির্জাখাল সংলগ্ন গিয়ে দৃশ্যটি দেখা গেছে। আকস্মিক এই বিপর্যয়ের পর ওই এলাকায় সড়ক সংস্কারের কাজ বন্ধ রেখেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, সিডিএ নিযুক্ত ঠিকাদার সাইফ পাওয়ারটেকের প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড বেশি লাভের আশায় মির্জাখালটি অতিরিক্ত খনন করে ফেলে। এতে খতিবেরহাট এলাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার স্থানে সড়কে প্রধান গার্ডওয়াল থেকে মাটি সরে গিয়ে ধসে পড়েছে খালের ভেতর। গত রমজানে টানা দুই ঘন্টার বৃষ্টিতে সড়কের ওপর হাঁটু পরিমাণ পানি জমে যায়। এতে বেশ কয়েকটি স্থানে সড়কের ওপর বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সংস্কার কাজ নিয়ে দুই সংস্থার টানাটানি এবং সামনে টানা বর্ষার মৌসুমে পুরো সড়কটি খালের ভিতরে ধসে পড়ার আশঙ্কার কথা জানান তারা।

সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) কর্তৃক খাল পুনঃখনন ও সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় ৭ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার সাবেক কৃষ্ণ খাল বর্তমান নয়া মির্জাখালে অতিরিক্ত খাল খননের ফলে প্রায় তিন কিলোমিটার খতিবেরহাট এলাকায় সড়কের গার্ডওয়ালের মাটি সরে গেছে। কয়েকটি স্থানে খণ্ড খণ্ডভাবে দেওয়া ধসে ভেঙে পড়েছে। কোথাও কোথাও সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া ওই এলাকা সংস্কার কাজ সম্পূর্ণ কাজ না হওয়ায় বন্ধ এলাকার লক্ষাধিক মানুষের হাঁটাচলা ও যানচলাচলে ব্যাহত হওয়ার চিত্রটি দেখা যায়।

অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেকের ই-ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সোহরাব আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার পর বিষয়টি সম্পর্কে বলতেই তিনি ফোন সংযোগ কেটে দেন। এরপর বক্তব্য জানতে বারবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।
সড়কের মাঝখানে বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে গত দেড় মাস ধরে কাজ বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছে এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। সামনে বর্ষা—এর মাঝে সিডিএর পক্ষ থেকে এক কিলোমিটার গার্ডওয়ালটির পুনঃসংস্কার করা না হলে টানা বৃষ্টিতে পুরো খতিবেরহাট রোডটি খালের ভেতরে চলে যাওয়া আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এছাড়া ৪ নম্বর ওয়ার্ড কালারপুল এলাকায় খাল খননের সময় এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িও খালে দেবে গেছে বলে জানা গেছে। এ ঘটনার পর সিডিএ কর্তৃপক্ষ জরুরিভিত্তিতে খালের সঙ্গে থাকা বাড়িটি লোহার অস্থায়ী গার্ডারের মাধ্যমে ‘প্রোটেকশন’ দিয়ে রেখেছে।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে চসিকের রোড সংস্কার করা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার মৌখিক ও চিঠি দিয়ে জানানোর পরও সিডিএ কর্তৃপক্ষ গার্ডওয়ালটির পুনঃসংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন চসিক নিযুক্ত ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার মো. ফেরদৌস।

তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিডিএ গার্ডওয়ালটি সংস্কার না করলে সড়কের কার্পেটিং কাজ করলেও তা স্থায়ী হবে না। বর্ষাকাল এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ সময় গার্ডওয়ালটির পুনঃসংস্কার না করলে টানা বৃষ্টিতে খতিবেরহাট এলাকার প্রায় এক কিলোমিটারের পুরো সড়কই খালের ভেতরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

জানা যায়, ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর চাঁন্দমিয়া সওদাগর রোড ও হিলভিউ হাউজিং সোসাইটি পর্যন্ত সড়ক সংস্কারের জন্য সাত কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে দুই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। চলতি জুনের ৩০ তারিখের মধ্যে কাজটি শেষ হওয়ার কথা ছিল।

জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা যমুনা টিভির সাংবাদিক সাজ্জাত হোসেন রনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘খতিবেরহাট এলাকায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস। ২০১৮ সালে ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হয় চসিকের সড়ক সংস্কারের কাজ। কিন্তু সংস্কারের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় প্রতিনিয়ত দুর্ভোগে আছেন এলাকাবাসী।’ তিনি আরো বলেন, ‘সিডিএর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত খাল খননের ফলে সড়ক সংস্কারের কাজ ঝুঁকিতে পড়ে গেছে। এখনই এ সমস্যার সমাধান না হলে বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়তে হবে এলাকাবাসীকে।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (খতিবেরহাট রোড সংস্কার ও উন্নয়ন) উপ-সহকারী প্রকৌশলী মশিউর রহমান সিদ্দিকী পাভেল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘খতিবেরহাট এলাকার সড়ক সংস্কারের কাজ প্রায় শেষ। কার্পেটিংয়ের কাজ বাকি আছে। গত রমজান থেকে প্রায় দেড় মাস ধরে সংস্কার কাজ বন্ধ। সিডিএ অতিরিক্ত খাল খনন করায় বৃষ্টির পানিতে গার্ডওয়ালটির মাটি সরে গিয়ে বেশ কয়েকটি স্থানে দেয়াল ভাঙ্গন ও সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা সিডিএকে দেড় মাস আগে চিঠি দিয়েছি গার্ডওয়ালটি পুনঃসংস্কার করে দেওয়ার জন্য। সিডিএর খামখেয়ালিপনার কারণে দুর্ভোগে পড়ছেন স্থানীয়রা। পাশাপাশি ওয়াসার লোকজন বিনা নোটিশে রাতের আধাঁরে বারবার রাস্তা কাটার ফলে সংস্থার কাজেরও ব্যাঘাত ঘটছে।’

এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর মোবারক আলী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘খাল খনন প্রকল্প নিয়োজিত সিডিএর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজের বিল বেশি তোলার আশায় নয়ামির্জা খালটি অতিরিক্ত খনন করে ফেলে। রমজানে টানা দুই ঘন্টার বৃষ্টির পানিতে গার্ডওয়ালটির নিচের মাটি সরে গিয়ে দেয়াল ধসে পড়েছে। এ অবস্থায় গার্ডওয়ালটি পুনঃসংস্কার না করলে রোডের কার্পেটিং স্থায়ী হবে না। এ কারণে রোড সংস্কারের কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।’

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সিডিএর কারণে চসিকের রোডে গার্ডওয়ালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক। এটা সংস্কার করে দেবে সিডিএ।’

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এ প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিকভাবে ১৬টি খাল চিহ্নিত করা হয়। খালগুলো পড়েছে হালিশহর, আগ্রাবাদ, চাক্তাই, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, মুরাদপুর, চকবাজার, বৃহত্তর বাকলিয়া, দেওয়ানবাজার, খাতুনগঞ্জ এলাকায়। এ প্রকল্পের ব্যয় নিরসনকল্পে পাঁচ হাজার ৬১৬ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা ২০১৭ সালে একনেকে পাস করে বাস্তবায়ন দায়িত্ব দেওয়া হয় সিডিএকে। এছাড়া সরকার ১৬টি খাল বাস্তবায়নের ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে সিডিএকে সহযোগিতা করছে সেনাবাহিনী। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঠিকাদারদের কিউবিক মিটারভিত্তিক কাজের টেন্ডার দেয় সিডিএ।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!