লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে

বাংলাদেশ-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ আজ

লন্ডনের কেনিংটন ওভাল। তিনশ বছরেরও পুরনো এই স্টেডিয়াম নানান কারণে বেশ ইতিহাসসমৃদ্ধ। ১৮৮০ সালে এই মাঠেই প্রথম ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল। এমনিতেই ইংল্যান্ডের সবকটি বিশ্বকাপ ভেন্যুই নয়নাভিরাম। এই মাঠেই বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হেসেখেলে হারিয়ে নিজেদের বিশ্বকাপ যাত্রা রঙিনভাবে শুরু করে ইংল্যান্ড। ইংল্যান্ডের সেই রঙ ছিল নীল। ইংল্যান্ডের নীল বিষের ছোবলে ছত্রখান হয়েছিল প্রোটিয়াদের সবুজ রঙ। লাল-সবুজের বাংলাদেশও আজ প্রস্তুত প্রোটিয়াদের সবুজ রঙ আরেকবার মলিন করে দেয়ার জন্য। সবুজকে মলিন করার জন্য ‘লাল’ পথেই হাঁটছে বাংলাদেশ। সবুজ প্রোটিয়ার বিপক্ষে আজ মাঠে নামবে লাল টাইগার। (বিশ্বকাপের দুটি ম্যাচে টাইগাররা লাল জার্সি পরে মাঠে নামবে, অন্যটি পাকিস্তানের বিপক্ষে)
লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 1
সকালের দৃশ্য:
ওভালে দলের অনুশীলনে ছিলেন ডেল স্টেইন। বোলিং করলেন বেশ অনেকক্ষণ ধরে। অবশ্য দৌড় বা বোলিংয়ে সেই তেড়ে ফুঁড়ে চলার মেজাজ নেই। এখনো ইনজুরি থেকে পুরোপুরি মুক্তি মেলেনি তার। আর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ম্যাচেও খেলছেন না স্টেইন। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত স্টেইন না খেললেও আজকের ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দক্ষিণ আফ্রিকার প্রচুর যে ডেলিভারি মোকাবেলা করতে হবে তার নাম-শর্ট বল, বাউন্সার!

বিকালের দৃশ্য:
ওভালের দুইপাশের নেটে ব্যাটিং করছে বাংলাদেশ। সৌম্য সরকার, লিটন দাস, মোহাম্মদ মিঠুনকে ব্যাটিং অনুশীলনের সেই সেশনে একের পর এক শর্ট বল দেয়া হচ্ছে। সেই বাউন্সারকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে হুক ও পুল শট খেলছেন ব্যাটসম্যানরা। মাঠের আরেক কোনার নেটে ব্যাট হাতে মুশফিক রহিম একা। নেট ঝুলিয়ে টানা হুক শট হাঁকাচ্ছেন মুশফিক।
লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 2
আজকের ম্যাচে যে এমন প্রচুর বাউন্সার উড়ে আসবে। সেই ডেলিভারি মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আগাম প্রস্তুতি। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের শক্তিমত্তা যেমন জানে দক্ষিণ আফ্রিকা, ঠিক তেমনই দূর্বলতা বেশ জানা তাদের। বিশ্বকাপের আজকের ম্যাচ বাংলাদেশের জন্য তাই ‘বাউন্সার’ এর ঝড় তোলার অপেক্ষায় দ. আফ্রিকা। নিশ্চিতভাবেই ব্যাটসম্যানদের পাঁজর লক্ষ্য করেই বোলিংয়ের পরিকল্পনা করছে প্রোটিয়ে বোলাররা।

অধিনায়ক মাশরাফিও জানেন এমন কায়দার বোলিংই করবে দক্ষিণ আফ্রিকা। বলছেন-‘খুবই স্বাভাবিক বিষয় যে ওরা বাউন্সার বা শর্ট বল করবেই। আর সেইধরনের বল মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতির বিষয়টা আসলে একেক জনের একেক রকম। ব্যাটসম্যানরা সেটা মোকাবেলা করার জন্যও প্রস্তুত আছে। আয়ারল্যান্ডে তিনজাতি ক্রিকেটেও আমাদেরকে এমনভাবেই টার্গেট করা হয়েছিলো। কিন্তু আমরা সেখানে তখন সফল হয়েছিলাম। এখানেও তেমনকিছুই ফাঁদ তৈরি করা হচ্ছে আমাদের জন্য। তবে সেই কৌশল মোকাবেলার জন্য আমার ব্যাটসম্যানরা প্রস্তুত। কিন্তু তারা যে সফল হবেই-এমন কোনো গ্যারান্টি দিতে আমি রাজি নই। এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি যে তারা দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিংয়ের বিপক্ষে লড়তে বেশ আত্মবিশ্বাসী এবং বেশ ভালো প্রস্তুতি তাদের আছে।’

নিজেদের ম্যাচ পরিকল্পনায় অটুট এবং স্থির থাকার ওপর জোর দিচ্ছেন অধিনায়ক-‘নতুন কিছু করার দরকার নেই। আমাদের যে শক্তি, যে সামর্থ্য আছে সেটা নিয়েই লড়তে হবে। আমরা যা পারি সেটাই করে দেখাতে হবে।’

বিশ্বকাপে হেড টু হেড:
মোট ম্যাচ: ৩টি, বাংলাদেশ জয়ী: ১টি। দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ী: ২টি। মুখোমুখি দুই দল মোট ম্যাচ: ২০টি। বাংলাদেশ জয়ী: ৩টি। দক্ষিণ আফ্রিকা জয়ী: ১৭টি। ড্র: ০টি ম্যাচ পরিত্যক্ত: ০টি।

প্রতিপক্ষ যখন দক্ষিণ আফ্রিকা তখন করে দেখানোর সেই লড়াইয়ে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হতে পারে এই দক্ষিণ আফ্রিকাই। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের সুপার এইটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেদফায় বিশ্বকে আরেকবার চমকে দিয়েছিলো বাংলাদেশ।

তবে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা যে বাংলাদেশের শুধু অনুপ্রেরণা নয়, দুঃস্বপ্নের কারণও বটে! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বনিম্ম রান হলো ৭৮। ২০১১ সালের বিশ্বকাপে সেই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

৮ বছর পুরানো সেই হিসেবের একটা বদলা নেয়ার বিষয়ও থাকছে বাংলাদেশের আজকের ম্যাচ এজেন্ডায়!

বাংলাদেশের শক্তির জায়গা
পঞ্চপাণ্ডব: বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম পাঁচ সেরা ক্রিকেটার মাশরাফী, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ- পাঁচজনই দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে খেলছেন। দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। এই অভিজ্ঞতাই বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে বিশ্বমঞ্চে। পাঁচজনের মধ্যে মাহমুদউল্লাহ নিজের তৃতীয় বিশ্বকাপ খেলছেন। বাকি চারজনেরই এটি চতুর্থ বিশ্বকাপ। মেগা-ইভেন্টে খেলার অভিজ্ঞতা তারা কাজে লাগাতে পারলে সেটি বাংলাদেশকে ইতিবাচক ফলাফলই এনে দেবে।

লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 3
একই ফ্রেমে বাংলাদেশের পঞ্চ পাণ্ডব

টপঅর্ডার: বাংলাদেশের টপঅর্ডার ব্যাটসম্যানরা নিয়মিত রান পাচ্ছেন। নতুন বলে উইকেট পাচ্ছেন পেসাররা। বিশ্বকাপেও এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে দারুণকিছু আশা করাই যায়।

টিম ইউনিট: বাংলাদেশের শক্তির সবচেয়ে বড় জায়গা হল টিম ইউনিট। আবু জায়েদ রাহি চমক হিসেবে জায়গা পেয়েছেন। অন্যদিকে গত বিশ্বকাপে খেলা ইমরুল কায়েস, তাসকিন আহমেদ ও শফিউল ইসলাম ছাড়া সবাই রয়েছেন দ্বাদশ বিশ্বকাপের দলে। দীর্ঘসময় একসঙ্গে খেলায় দারুণ এক ইউনিট গড়ে উঠেছে টিমের মধ্যে।

গভীরতা: বাংলাদেশের ব্যাটিং গভীরতাও চোখে পড়ার মতো। ব্যাটিংয়ে সিদ্ধহস্ত মাশরাফী ৯ নম্বর পজিশনে ক্রিজে আসেন, এটিই টিম বাংলাদেশের ব্যাটিং-গভীরতা নির্দেশ করে। তামিম, সাকিব, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির রহমান, মোসাদ্দেক হোসেন ও মেহেদী হাসান মিরাজ- ব্যাটিংয়ে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেল বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। যাতে নতুন সংযোজন সাইফউদ্দিন। সবাই একসঙ্গে জ্বলে উঠলে এবং পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা থাকলে দ্বাদশ বিশ্বকাপে অবিস্মরণীয় কিছু করে দেখাতে পারে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের দুর্বল জায়গা:
ডেথ ওভার: এখানে দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। চার-ছক্কার ফুলঝুরির ক্রিকেটে পার্থক্য গড়ে দেয় ডেথ ওভারের পারফরম্যান্স। এক্ষেত্রে ব্যাটিং-বোলিং দুই ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ডেথ ওভারে বাংলাদেশের বোলাররা খেই হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ দলের আক্রমণভাগের প্রধান সেনানী মোস্তাফিজও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে টাইগারদের।

অন্যদিকে, প্রতিপক্ষ দলগুলো ডেথ ওভারগুলোয় যেখানে রানবন্যা বইয়ে দেয়, সেখানে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা নিজেদের ঠিকমতো মেলে ধরতে ব্যর্থ হন প্রায়ই। শেষদিকে মাহমুদউল্লাহ, মোসাদ্দেক, মাশরাফী ও সাইফউদ্দিনরা ব্যাট হাতে ঝড় তুলতে পারলে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারবে টাইগাররা।

রিস্ট স্পিনার না থাকা: ইংল্যান্ডের সিমিং কন্ডিশনে স্পিনাররা কোনো সুবিধা পাবেন না বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু উদ্বোধনী ম্যাচে ইমরান তাহির সেটিকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। সাউথ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড ও ভারত রিস্ট স্পিনার থাকায় ইংলিশ কন্ডিশনে বাড়তি সুবিধা পাবে। আর না থাকায় পিছিয়ে থাকবে বাংলাদেশ।

গতির বোলার না থাকা: বাংলাদেশ দলে গতির ঝড় তোলার মতো বোলার নেই বললেই চলে। রুবেল আছেন, তবে একাদশে প্রথম পছন্দ নন। মোস্তাফিজ ইয়র্কার ও কাটারে গতির ঘাটতি অনেকটাই পুষিয়ে দিতে সক্ষম। তবে অন্যরা কেমন করেন সেটিই দেখার।

মাঠের লড়াইয়ে এখন আর পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দৃঢ়। বিশ্ব ক্রিকেটের পরশক্তিদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে টাইগাররা। লড়াইয়ে যে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই তা পরিষ্কার আয়ারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজেই।

দৃষ্টি থাকবে যাদের ওপর:
তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)।

লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 4
তামিম ইকবাল

লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 5
বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান

কুইন্টন ডি কক, কেগিসো রাবাডা (দক্ষিণ আফ্রিকা)।
লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 6
কুইন্টন ডি কক

লন্ডনের কেনিংটন ওভাল সাজুক লাল-সবুজে 7
রাবাদা

বাংলাদেশের সম্ভাব্য একাদশ: তামিম ইকবাল, সৌম্য সরকার, সাকিব আল হাসান (সহ-অধিনায়ক), মুশফিকুর রহিম, মোহাম্মদ মিঠুন, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, সাব্বির রহমান, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন/ মেহেদি হাসান মিরাজ, মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা (অধিনায়ক), মোস্তাফিজুর রহমান, রুবেল হোসেন।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!