মানুষ জিম্মি করে গাড়ির ধর্মঘট, চট্টগ্রামজুড়ে পথে পথে দুর্দশা

রোববারের আগে ধর্মঘট ওঠার সম্ভাবনা কম

১১ মাস আগে ওমান থেকে দেশে ফেরা লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা আফসার উদ্দিন ফ্লাইট শনিবার সকাল ৯টায়। লক্ষ্মীপুর থেকে কোনোমতে তিনি নোয়াখালী আসলেও চট্টগ্রাম আসার পথ আর খুঁজে পাচ্ছেন না। শুক্রবার রাতের মধ্যেই চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পৌঁছাতে না পারলে তার আর ওমান যাওয়া হবে না। গাড়ির খোঁজে বিকেল পর্যন্ত ছুটোছুটি করে গেলেও শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি, তিনি আদৌ চট্টগ্রামে পৌঁছাতে পেরেছেন কিনা। তবে তিনি একা নন, পরিবহনের হঠাৎ ধর্মঘটে এমন দশায় পড়তে হয়েছে আরও অনেককেই।

সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় রোববারের আগে পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও তৈরি হয়েছে অবর্ণনীয় এক অবস্থা। পরিবহন ধর্মঘটের কবলে পড়ে পথে পথে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। শিশু ও বয়স্কদের অবস্থা সবচেয়ে করুণ। স্থবির হয়ে পড়েছে মানুষের জীবিকা ও অন্যান্য জরুরি প্রয়োজনের ভ্রমণ।

বুধবার (৩ নভেম্বর) দিবাগত রাতে ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। এমন সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সকাল থেকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরিচালক-মালিকেরা গাড়ি চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ধর্মঘটে যোগ দেন বাসচালক ও মালিকরা। চট্টগ্রামেও নগর, উত্তর, দক্ষিণসহ সব এলাকার মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো একজোট হয়ে গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছে।

এদিকে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধিতে জীবনযাত্রার ব্যয় ও পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ার শঙ্কাও তৈরি হচ্ছে। ট্রাক, বাসসহ পরিবহনের জ্বালানি হিসেবেই ডিজেলের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, ট্রাক ভাড়া বাড়লে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়ে যাবে। দাম বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। চাপ পড়বে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর।

পরিবহনের হঠাৎ ধর্মঘটে চট্টগ্রামজুড়ে যাত্রীরা পড়েছেন চরম দুর্দশায়। শুক্রবার দিনভর চট্টগ্রামের দুটি দূরপাল্লার বাস টার্মিনাল এলাকায় যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। বাসের অপেক্ষায় তারা দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু বাসের দেখা আর পাননি। কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে অটোরিকশা কিংবা মোটরসাইকেলে করে কাছের গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হতে দেখা গেছে অনেককে। শুক্রবার সাধারণ যাত্রীদের অনেকেই ধর্মঘটের কথা না জেনে বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য রাস্তায় বের হন। কিন্তু সড়কে কোনো গণপরিবহন না পেয়ে পড়ে যান চরম ভোগান্তিতে।

চট্টগ্রামে বাস চলাচল বন্ধ থাকায় রিকশা, সিএনজি ও অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের ভরসা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রিকশাচালক ও সিএনজিচালকরা ভাড়াও হাঁকছেন বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বিগুণ ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশাগুলো ২০০ টাকার ভাড়া ৫০০ টাকা চাইতেও দ্বিধা করছে না। চড়তে চাইলে এই ভাড়া না দিয়েও উপায় নেই।

তবে চট্টগ্রামের জনবহুল কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা গেছে, গণপরিবহন না থাকায় পুরো সড়কই মূলত রিকশার দখলে। রিকশাচালকদের দম ফেলার সময় যেন নেই। একটু দরদাম করলেই ফিরিয়ে নিচ্ছেন মুখ। অন্যদিকে কিন্তু মোটরসাইকেল চালকরাও সুযোগ পেয়ে অ্যাপস বন্ধ করে চুক্তিতে যাত্রীদের যেতে বাধ্য করছেন।

চট্টগ্রাম নগর থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অলংকার মোড় ও এ কে খান মোড় থেকে শুক্রবার থেকে আর দূরপাল্লার বাস ছাড়েনি একটিও। সেখানে বাসের কাউন্টারগুলোও বন্ধ রয়েছে। এমন অবস্থায় পড়ে যাত্রীরা রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছেন। বাস হয়তো ছাড়তে পারে— এই আশায় অনেকে বাসের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করেও গন্তব্যে আর যেতে পারেননি।

অন্যদিকে নগরীর ভেতরেও বাস চলাচল করছে না। শুক্রবার দিনভর নগরীর মুরাদপুর, জিইসি মোড়, অক্সিজেন, আগ্রাবাদ, বহদ্দারহাট, কাপ্তাই রাস্তার মাথা ও টাইগারপাস এলাকায় বাস চলাচল তেমন একটা দেখা যায়নি। হঠাৎ দু একটি বাস চললেও সেগুলোতে মানুষ যে যেভাবে পেরেছে, ঠাসাঠাসি করে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউমার্কেটগামী এই বাসগুলোও মূলত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা উপলক্ষে রাস্তায় নামে।

এদিকে কাভার্ডভ্যান-ট্রাক-প্রাইমমুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতিও কর্মবিরতি পালন করায় চট্টগ্রাম বন্দর ছাড়াও ১৯টি আইসিডি থেকে পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সকাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নজিরবিহীন কন্টেইনার জটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন ৮ হাজারেরও বেশি যানবাহন বন্দর থেকে পণ্য আনা-নেওয়ার কাজ করে থাকে।

পরিবহন চালক ও মালিকরা যুক্তি দিচ্ছেন, জ্বালানি তেলের দাম ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করায় তাদের তাদের পক্ষে গাড়ি রাস্তায় নামানো সম্ভব নয়। তারা বলছেন, তেলের বর্ধিত দামের সঙ্গে যদি পরিবহন ভাড়া সমন্বয় করা না হয় তাহলে তাদের পক্ষে গাড়ি চালানো সম্ভব নয়।

এদিকে যাত্রীরাই শুধু নয়, করোনাকালে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর হঠাৎ করে আবার গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন পরিবহন শ্রমিকরাও। করোনার লকডাউনে দীর্ঘদিন এদের প্রায় সকলেই ঘরে বসে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটিয়েছেন। এখন গণপরিবহনের হঠাৎ ধর্মঘটে পরিবার-পরিজন নিয়ে তারাও ক্ষতির মুখে পড়ে গেছেন।

চলমান অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে শুক্রবার (৫ নভেম্বর) সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, রোববার (৭ নভেম্বর) বিআরটিএর ভাড়া পুননির্ধারণ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সে হিসেবে রোববারের আগে এই পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহার হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!