বেহিসাবি অ্যান্টিবায়োটিক ডেকে আনছে বড় বিপদ, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ ১০ হাসপাতালে গবেষণা

করোনায় অ্যান্টিবায়োটিক কাজ দেয় না, তবু যথেচ্ছ ব্যবহার

অ্যান্টিবায়োটিকের বেহিসাবি ব্যবহার স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে বাংলাদেশে। ডাক্তাররা যেমন দ্রুত রোগ সারিয়ে নাম করার জন্য বিচার বিবেচনা না করেই রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক কিনে ব্যবহার করছেন। যা হয়ে উঠেছে রীতিমতো আতঙ্কের কারণ। এজন্য ডাক্তাররা যেমন দায়ী, তেমনি রোগীদেরও আছে দায়। সাম্প্রতিক সবকটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রোগজীবাণুর প্রতিরোধী হয়ে ওঠা মারাত্মক মহামারিও তৈরি করতে পারে— যা ছড়িয়ে যেতে পারে এমনকি সারা বিশ্বেই।

চট্টগ্রামের দুই হাসপাতাল ছাড়াও দেশের আরও আটটি হাসপাতালে পরিচালিত সর্বশেষ এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডাক্তাররা হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য অবিবেচকের মতো ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার করছেন, প্রেসক্রিপশনে লিখছেন— যা ব্যাকটেরিয়া নিধনে জীবনরক্ষাকারী ওষুধের কার্যকারিতাই কমিয়ে দিচ্ছে।

এই গবেষণার সাথে জড়িত গবেষকরা বলেছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের এই ধরনের অযৌক্তিক ব্যবহার রোগীদের ওপর একইসঙ্গে চাপিয়ে দিচ্ছে অহেতুক আর্থিক বোঝাও।

চট্টগ্রাম ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটে পাঁচটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল এবং পাঁচটি সাধারণ হাসপাতালে এই গবেষণা পরিচালনা করা হয় চলতি বছরের ১ মে থেকে ৩০ জুলাই পর্যন্ত। এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে পাঁচটি সরকারি ও পাঁচটি বেসরকারি। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল।

বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ (আইইডিসিআর) এবং আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি (এএসএম) যৌথভাবে ‘বাংলাদেশের হাসপাতালে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার এবং এন্টিমাইক্রোবিয়াল প্রতিরোধ’ বিষয়ক এই গবেষণা চালায়।

অন্তত এক শতাব্দী ধরে ব্যাকটেরিয়া বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টিবায়োটিক’ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন ওষুধের ব্যবহার হয়ে আসছে। অনেক ক্ষেত্রে এগুলো ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংসে কার্যকর বলে মনে করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এর ক্ষতিকর দিকগুলোও সামনে উঠে আসছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহারের কারণে ব্যাকটেরিয়ার কিছু প্রজাতি তাদের ডিএনএ-তে ছোট ছোট পরিবর্তন ঘটিয়ে নিজেদের বদলে ফেলতে সক্ষম হচ্ছে। অনেক ব্যাকটেরিয়া হয়ে উঠছে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ‘সুপারবাগ’। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের অবিবেচক ব্যবহারের কারণেই এসব ঘটছে।

২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিককে তিনটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের সংক্রমণের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘অ্যাক্সেস গ্রুপ’ভুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক। উচ্চতর ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ওয়াচ গ্রুপ’ভুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক। অন্যদিকে ‘রিজার্ভ গ্রুপ’ভুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক কেবল তখনই ব্যবহার করা হয়, যখন বাকি সমস্ত বিকল্পই ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশের সরকারি চিকিৎসা গবেষণা কেন্দ্র আইইডিসিআরের গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তাররা তাদের প্রেসক্রিপশনে প্রায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে ওষুধ হিসেবে লিখেছেন ‘ওয়াচ গ্রুপের’ অ্যান্টিবায়োটিক। ‘অ্যাক্সেস গ্রুপের’ অ্যান্টিবায়োটিক লেখা হয়েছে ২৮ শতাংশ রোগীর বেলায়। অন্যদিকে ‘রিজার্ভ গ্রুপের’ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছেন ০.৮ শতাংশ রোগীকে। আবার ০.৪ শতাংশ রোগীকে এমন সব অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে— যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদনই করে না।

আইইডিসিআরের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জাকির হোসেন হাবিব বলেন, ‘প্রেসক্রিপশনে ওয়াচ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক লেখার সময় ডাক্তারদের সতর্ক থাকা উচিত। কারণ এই গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো থেকে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

চট্টগ্রামসহ দেশের ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটের বিভিন্ন হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড ও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন রোগীদের দেওয়া ওষুধের ওপর ভিত্তি করে গবেষকরা শীর্ষ ১০টি অ্যান্টিবায়োটিকের একটি তালিকা তৈরি করেছেন। এতে দেখা গেছে, পাঁচটি করোনা-ডেডিকেটেড হাসপাতালের চারটিতেই বেশিরভাগ রোগীর জন্য চিকিৎসকদের প্রথম পছন্দ ছিল ‘সেফট্রিয়াক্সোন’ নামের একটি অ্যান্টিবায়োটিক।

যেমন চট্টগ্রামের হাসপাতাল ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি) চিকিৎসা নেওয়া ৬২.৮ শতাংশ করোনারোগীকেই ডাক্তাররা দিয়েছেন সেফট্রিয়াক্সন। এরপরেই যে দুটি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে অ্যামোক্সিসিলিন এবং ক্ল্যাভুলানিক অ্যাসিড। ২৪.৮ ভাগ রোগীকে পরের এই দুটি ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও ৩০.৭ শতাংশ করোনারোগীকেই ডাক্তাররা দিয়েছেন সেফট্রিয়াক্সন নামের অ্যান্টিবায়োটিকটি। একইভাবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫৫.৮ শতাংশ, সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতালে ৫৩.৬ শতাংশ এবং রাজধানীর উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৭.৯ শতাংশ রোগীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারদের প্রথম পছন্দ ছিল ওই সেফট্রিয়াক্সন।

চার বছর আগে, ২০১৭ সালে আইইডিসিআরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সেফট্রিয়াক্সন নামের এই অ্যান্টিবায়োটিক অনেক ক্ষেত্রেই ই-কোলি, প্রোটিয়াস এসপিপি, নন-টাইফয়েডাল সালমোনেলা এবং অ্যাসিনেটোব্যাক্টর কমপ্লেক্স ছাড়াও অন্য আরও অনেক ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করতে পারে না।

সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের দুই হাসপাতালসহ অন্তত পাঁচটি হাসপাতালে ব্যবহৃত শীর্ষ ১০টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে রয়েছে ‘মেরোপেনেম’ নামের একটি ওষুধ। আইসিইউতে থাকা রোগীদেরকে এই অ্যান্টিবায়োটিকটি দেওয়া হয়েছে ব্যাপকভাবে।

ডা. জাকির বলছেন, ‘কোভিড-১৯ বা করোনা একটি ভাইরাল সংক্রমণ। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো এই সংক্রমণের চিকিৎসায় কোনো কাজে আসে না। গৌণ ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের সম্ভাবনা না থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করাই উচিত নয়। অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। তাছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার রোগীদের ওপর অহেতুক আর্থিক বোঝাও চাপিয়ে দেয়।’

তিনি বলেন, ‘সেফট্রিয়াক্সন একটি ব্যয়বহুল ও অতি মূল্যায়িত ওষুধ। যথাযথ যাচাইবাছাই ছাড়া এটি ব্যবহার করা উচিত নয়।’

করোনা রোগীদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ‘মেরোপেনেম’-এর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে ডা. জাকির বলেন, ‘ডাক্তারদের এই ওষুধ ব্যবহারের বিষয়ে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। যখনই সম্ভব এটি বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।’

এর আগে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল (এমজিএইচ) পরিচালিত এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করছে না। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই এটি শিশুদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ না থাকা শিশুদের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনা ১৭ গুণ বেশি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!