বেতন দেবে বলে ডেকে আগ্রাবাদের বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেল সামান্য টাকা ধরিয়ে দিল

অভাব-অনটনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কর্মচারীরা রোববার (৫ জুলাই) ‘আমাদের বেতন দিন, আমাদের বাঁচান’— শ্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান নেন চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের তারকা হোটেল বেস্ট ওয়েস্টার্নের প্রবেশমুখে। প্রশাসনের চাপের মুখে সেই কর্মীদের চার মাসের বকেয়া বেতন দেবে বলে ডেকে সোমবার (৬ জুলাই) ধরিয়ে দেওয়া হল দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা মাত্র। অথচ বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক আশা নিয়ে বেতন নিতে গাড়িভাড়া ধার করে এসেছিল অনটনে থাকা এই কর্মীরা। এক বেলা খাবার জোগাড় করতেই এখন এই কর্মীদের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়ে উঠেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘বেস্ট ওয়েস্টার্ন’ হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে রীতিমতো প্রতারণাই করলো— কান্নাজড়িত কণ্ঠে এমন অভিযোগ করলেন বেতনবঞ্চিত কর্মীরা।

জানা গেছে, বেতনের দাবিতে হোটেলটির কিছু কর্মচারী প্রকাশ্য আন্দোলনে গেলেও চার তারকামানের হোটেল বেস্ট ওয়েস্টার্নের ভেতরের গল্প আরও করুণ। মোট ১২৬ জন কর্মচারীর মধ্যে আন্দোলনের বাইরে থাকা আরও ১১৬ জন মাসের পর মাস বেতন পাচ্ছেন না। এমনকি বেতন পাবেন কিনা তাও তারা জানেন না। চাকরি হারানোর ভয়ে আন্দোলনে যেতেও ভয় পাচ্ছেন তারা। এছাড়া হোটেলটির নয়টি বিভাগের প্রধানরা বেতন পাচ্ছেন না সেই ফেব্রুয়ারি মাস থেকে। এতে অনেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

গত ৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ২০ তলা একটি ভবন ভাড়া নিয়ে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের হোটেল ‘বেস্ট ওয়েস্টার্ন’। চার তারকা মানের এই হোটেলের চেয়ারম্যান মো. শাহ আলম এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মামুন উর রহমান। শাহ আলম লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল ডিস্টিক্ট ৩১৫-বি৪ এর সাবেক গভর্নর। অন্যদিকে এমডি মামুন আগ্রাবাদের অ্যামব্রোশিয়া নামের আরেকটি রেস্টুরেন্ট ও ওআর নিজাম রোডের অ্যামবেসেডর হোটেলেরও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

বেতন দেবে বলে ডেকে আগ্রাবাদের বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেল সামান্য টাকা ধরিয়ে দিল 1

জানা গেছে, কর্মচারীদের বেতনসহ নানা বঞ্চনার পেছনে রয়েছে হোটেলটির এমডি মামুন উর রহমান ও হোটেলের অংশীদার নাজমুল হোসাইন টুটুলের অদক্ষতা ও প্ররোচনা। হোটেলটি মুখ থুবড়ে পড়ার জন্য এর বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীই এই দুজনকে দায়ী করছেন। হোটেলটির একজন কর্মকর্তা জানান, বছরের শুরুতে কর্মচারীদের বেতন বাবদ একটি ফান্ড এমডি মামুনের হাতে দেওয়া হলেও তিনি কর্মচারীদের বেতন না দিয়ে ঘোরাচ্ছেন শুরু থেকেই।

এমন অবস্থায় অনেকে বেতন না পেয়ে হকারের কাজসহ নানা ধরনের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। করোনাকালে বেতনের জন্য হোটেলে ছোটাছুটি ও এমডি মামুনের মোবাইলে কল করেও কোন সাড়া পান না। দীর্ঘ চার মাস এভাবে বেতনের জন্য ধরনা দিতে দিতে অবশেষে তারা আন্দোলনে নামেন।

রোববার (৫ জুলাই) বেতনের দাবিতে কর্মচারীরা হোটেলের সামনে অবস্থান নিয়ে হোটেলের ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়। দিনভর নানা অজুহাতের পর বিকেলে ডবলমুরিং থানার সহায়তায় হোটেল কর্তৃপক্ষ সোমবারের (৬ জুলাই) মধ্যে সব বেতন পরিশোধের কথা জানান। ওইদিন বেতন নিতে এসে মাথায় হাত পড়ে আন্দোলনকারীদের। তারা আরও এক দফা প্রতারণার শিকার হলেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো কিছু টাকা ধরিয়ে বিদায় করে দেয় তাদের। বাকি বেতন কখন দেবে তাও জানাতে চায়নি হোটেল কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, হোটেলের কর্মচারীদের মধ্যে শরিফ আহমেদের মাসিক বেতন ১১ হাজার করে ৪ মাসে তার পাওনা ৪৪ হাজার টাকা, মো. ইকবাল হোসেনের মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা করে পাওনা ৪৮ হাজার টাকা, যীশু কান্তির মাসিক বেতন ১৬ হাজার করে পাওনা ৬৪ হাজার টাকা, নাসির উদ্দিন ৮ হাজার করে পাওনা ৩২ হাজার টাকা, তৌহিদুল আলম ৮ হাজার করে পাওনা ৩২ হাজার টাকা, আকাশ মিত্র ৮ হাজার টাকা করে ৩ মাসের পাওনা ২৪ হাজার টাকা, নুর ইসলাম ৮ হাজার ৫০০ টাকা করে পাওনা ৩৪ হাজার টাকা, সাজ্জাদ খান ৬ হাজার টাকা করে পাওনা ২৪ হাজার টাকা, আরিফুর রহমান ৮ হাজার টাকা করে পাওনা ৩২ হাজার টাকা, জয়ধন দাশের ৭ হাজার টাকা করে পাওনা ২৮ হাজার টাকা, আরাফাত আলীর ৮ হাজার টাকা করে পাওনা ৩২ হাজার টাকা।

এদিকে চাপের মুখে বেস্ট ওয়েস্টার্ন হোটেল কর্তৃপক্ষ ৪৪ হাজার টাকা পাবেন যে শরিফ আহমেদ, তাকে দিয়েছেন মাত্র ৫ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে ইকবাল হোসেনকে ৬ হাজার, যীশু কান্তিকে ৮ হাজার, নাসির উদ্দিনকে ৪ হাজার, তৌহিদুল আলমকে ৪ হাজার টাকা, আকাশ মিত্রকে ২ হাজার টাকা, নুরুল ইসলামকে ৪ হাজার ২৫০ টাকা, সাজ্জাদ খানকে ৩ হাজার টাকা, আরিফুর রহমানকে ৪ হাজার টাকা, জয়ধন দাশকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা, আরাফাত আলীকে ৪ হাজার টাকা করে ধরিয়ে দেয়। পুরো বেতন পরিশোধের কথা বলে এভাবে ভিক্ষার মতো করে কিছু টাকা ধরিয়ে দেওয়াকে তাদের সাথে চরম অমানবিকতা ও প্রতারণা করা হয়েছে বলে জানান কর্মীরা। তারা বলেন, বিভিন্ন জেলায় বসবাস করেন তারা। অন্যের কাছ থেকে গাড়ি ভাড়া ধার করে বেতনের জন্য এসে এমন আচরণে পুরো হতবাক।

কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধের ব্যাপারে জানতে চাইলে আগ্রাবাদের বেস্ট ওয়েস্টার্ন অ্যালায়েন্স হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন উর রহমান ‘ব্যস্ত আছি’ বলে ফোন কেটে দেন। এরপর তাকে আর ওই মোবাইলে পাওয়া যায়নি।

সিএম/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!