প্রত্যাবাসন/ শর্তে অনড় রোহিঙ্গারা, নেপথ্যে সক্রিয় উগ্রপন্থীরা

রোহিঙ্গাদের নানা দাবির কারণে অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাতকার পর্বের মাধ্যমে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ইউএনএইচসিআর, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) প্রত্যাবাসনের প্রাথমিক দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে।

টেকনাফের নয়াপাড়া শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (২৬ নম্বর) ইনচার্জ খালেদ হোসেন জানান, মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ২১ পরিবার এবং বুধবার (২১ আগস্ট) ১০৫ পরিবারে সাক্ষাতকার নিয়েছেন।

প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা ৩ হাজার ৪৫০ জনের মধ্যে কয়েকজন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে নুর হাশেম (৩২) অনেক ভয়ে কথা বলা শুরু করে। পরে পাশ্ববর্তী স্থানে ওঁৎপেতে থাকা রোহিঙ্গা উগ্রপন্থী সংগঠনের নেতাদের তৎপরতায় ভয়ে পিতার নাম পর্যন্ত বলতে পারেনি। তাদের কিছু শর্ত রয়েছে যা মানলে তারা মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজী। অন্যথায় তারা ফিরবে না। এমনকি গুলি করে মেরে ফেললেও তারা শর্তপূরণ ছাড়া ফিরতে রাজী নয়।

সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, আকিয়াব জেলায় আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের নিজ বাড়িতে ফেরত, কারাগারে বন্দি রোহিঙ্গাদের মুক্তি, হত্যা, ধর্ষণের বিচার, অবাধ চলাফেরা, নিরাপত্তা প্রদানসহ একাধিক শর্ত পূরণ না হলেই স্বদেশ ফিরবে না রোহিঙ্গারা।

ক্যাম্প কর্তৃপক্ষ ও ইউএনএইচসিআর’র লোকজন রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে গিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে ২২ আগস্ট স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বার্তা। এ সময় অনেক রোহিঙ্গা ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। আবার অনেকে এসব শর্ত জুড়ে দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা বলেন, ‌‘যারা আরাকানে ৬টা ছাগল ছরায়নি তারাও এখানে ১০০ বেশি রোহিঙ্গা পরিবারের মাঝিগিরি করছে। তাদের কারণে আমরা নিজ দেশে ফিরতে পারছি না।’

প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা মো. জুবাইর জানান, ইউএনএইচসিআর এর প্রতিনিধি দল সকালে এসে পারিবারিক ডাটা কার্ড খুঁজেন। তারা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কিছু জানায়নি। পরে জানতে পারি প্রত্যাবাসনের তালিকায় আমার নাম রয়েছে।

মিয়ানমারের বুচিডং চাংচিপ্রাং এলাকার জোবাইর স্বদেশে ফিরবে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি কয়েকটি শর্তজুড়ে দিয়ে বলেন, ‘নিজের দেশে ফিরতে ব্যাকুল হয়ে আছি। নাগরিকত্ব, ভিটে-বাড়ি ও জমি-জমা ফেরত, অবাধ চলাফেরা ও নিরাপত্তা দিলেই ফিরব। এভাবে গেলে মরণ নিশ্চিত। এর চেয়ে এদেশে মৃত্যুই ভালো।

তালিকায় থাকা হাসিনা বেগম বলেন, স্বামী-সন্তানদের নিরাপত্তা কে দিবে। ওখানে গিয়ে আশ্রয় শিবিরে রাখবে। অবাধ চলাফেরা করা যাবে না। রোহিঙ্গা স্বীকৃতি দেবে না। তবে কি নিয়ে আমরা স্বদেশ ফিরব।
একই ব্লকের জয়নব বেগম বলেন, মিয়ানমার সরকারকে বিশ্বাস করা যায় না। এর আগেও তারা অনেকবার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। তাই সরাসরি নাগরিকত্ব প্রদান করলেই আমরা ফিরতে পারি।

শালবন ক্যাম্পের ডি ব্লকের রোহিঙ্গা মাঝি নুর মোহাম্মদ রোহিঙ্গাদের দাবীর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, মিয়ানমারে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দিতে হবে। পূর্ণ নাগরিকত্ব দিয়ে গোঠা মিয়ানমারে অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে হবে।

এদিকে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা কিছু রোহিঙ্গা মঙ্গলবার ও বুধবার ২৬ নম্বর ক্যাম্পের সিআইসি (ক্যাম্প ইনচার্জ) অফিসের কাছে বিক্ষোভ করেছে। এসময় নিজেদের দাবী তুলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ বিক্ষোভ করেন রোহিঙ্গারা। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া মোস্তফা কামাল, শফিকা একই শর্ত জুড়ে দেন।

আবার সাধারণ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ জানান, ক্যাম্পে তারা স্বাধীন মতামত দিতে পারছেন না। রোহিঙ্গা স্বশস্ত্র গ্রুপ সবসময় তাদের উপর নজরদারী করেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে এগিয়ে নিতে ইউএনএইচসিআর ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কাছে লিফলেট বিতরণ করেছে। লিফলেটে স্বদেশ ফিরে গিয়ে কোথায়, কিভাবে রাখা হবে এবং পরবর্তীতে কি কি করণীয় সে সম্পর্কে ধারণা রয়েছে।

প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরনতলী ও নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে দুটি ট্রানজিট ঘাট আগেই তৈরি করা ছিল। বাকী ছিল তালিকায় থাকা রোহিংগাদের সাক্ষাতকার পর্ব তথা মতামত নেওয়া।

রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানান, ‘প্রত্যাবাসন কার্যক্রমের জন্য সকল প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা আশাবাদী ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসন হবে। পাশাপাশি সকাল থেকে ইউএনএইচসিআর’র লোকজন তালিকাভূক্ত রোহিঙ্গাদের সাক্ষাতকার নিচ্ছে এবং এসব লোকজনকে সংশ্লিষ্টরা নানানভাবে সহযোগীতা করে যাচ্ছে।

গতবছরের ১৫ নভেম্বর প্রথমদফা রোহিংঙ্গা প্রত্যাবাসনের ধার্য্য দিন রোহিঙ্গাদের অনিচ্ছার কারণে প্রত্যাবাসন করা যায়নি। তবে এবার রোহিঙ্গা সাক্ষাতকার পর্বে অংশ নেওয়ায় বুঝিয়ে দিচ্ছে তারা এখন আগের চেয়ে অনেক ইতিবাচক। এমন মন্তব্য শরণার্থী কমিশনারের।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট রাখাইনের নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। পুরনোসহ উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, এই সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।

এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!