‘নিয়ন্ত্রণহীন’ করোনায় বাড়ছে দুর্গতি, চট্টগ্রামে আইসিইউর জন্য হাহাকার

চট্টগ্রামের সিনিয়র সাংবাদিক মিজান। নিজের বাবাকে করোনা সন্দেহে তিন দিন আগে ভর্তি করিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পর পর দুবার টেস্টের পরও করোনা নেগেটিভ আসে। কিন্তু তার পিতার অক্সিজেন সিচুরেশন আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকায় বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) সন্ধ্যা থেকে পাগলের মতো চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে চষে বেড়ান একটি আইসিইউ সিটের জন্য। কিন্তু কোথাও মিলছিল না একটিও খালি শয্যা। শুধু মিজান নয়, পুরো চট্টগ্রামের দৃশ্য এখন এরকম—কোথাও খালি নেই আইসিইউ শয্যা।

চট্টগ্রামে দ্বিতীয় দফায় করোনার সংক্রমণ বাড়ার সাথেই মূলত চাহিদা বাড়তে শুরু করে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ)। গত কয়েকদিনে শনাক্তের ঊর্ধ্বগতির কারণে আইসিইউর সিট এখন হাহাকারে পরিণত হয়েছে। সর্বশেষ ১ এপ্রিল চট্টগ্রামে আবারও জোড়া প্রাণ কেড়ে নেয় করোনা। এ সময়ের মধ্যে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন আরও ২৮৭ জন। এ নিয়ে চট্টগ্রামে মোট মৃতের সংখ্যা ৩৮৮ এবং শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ২৮৩ জনে। তাই আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় চাপ বেড়েছে আইসিইউতে। রোগীর অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউর ব্যবস্থা করতে বিপাকে পড়ছেন স্বজনরা।

চট্টগ্রাম নগরে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলে মোট আইসিইউ শয্যার সংখ্যা ১১০টি। বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব আইসিইউ বেডের একটিও খালি নেই। করোনা ভাইরাসের ঊর্ধ্বগতির সাথে সাথে নগরীতে প্রকট আকারে বাড়ছে আইসিইউ বেডের সংকট।

নগরীর সরকারি প্রধান দুই হাসপাতাল- চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের এবং করোনা রোগীর চিকিৎসায় বিশেষায়িত হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালের ৩০টি আইসিইউ’র সবকটিতে রোগী ভর্তি। একই সাথে পার্কভিউ হাসপাতাল, মেট্রোপলিটন হসপিটাল, সিএসসিআর, ডেল্টা হেলথ ক্লিনিক, মা ও শিশু হাসপাতালে, ম্যাক্স হসপিটাল, ন্যাশনাল হসপিটাল ও মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড আছে ৮০টি। যার সবকটিতে এখন রোগীতে ভরপুর।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আবদুর রউফ জানিয়েছেন, চমেক ও জেনারেল এ দুই হাসপাতালের মোট ১৬টি আইসিইউ ও চারটি এইচডিইউর সব কটিতে রোগী ভর্তি রয়েছে।

একই অবস্থা নগরের বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও। চট্টগ্রাম বেসরকারি হাসপাতাল ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে ৮০টি আইসিইউ সচল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এর সবটিতে রোগী চিকিৎসাধীন আছেন।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আমার পরিচিত একজন রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়ায় ওই রোগীর জন্য তার স্বজনেরা সরকারি হাসপাতালে একটি আইসিইউ সিটের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেও সফল হননি।’

বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে ৯টি করে আইসিইউ ও এইচডিইউ শয্যা রয়েছে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এর সবটিতেই রোগী ভর্তি রয়েছে। এছাড়াও, ৬০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ডের সবকটিতে রোগী ভর্তি আছে।’

তবে করোনা আক্রান্ত সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘করোনার চিকিৎসায় আইসিইউ এর চেয়ে অক্সিজেন আর হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা সবচেয়ে বেশি দরকার। সেসব ক্ষেত্রে আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে। তবুও পরিস্থিতি যেভাবে বদলাচ্ছে, মানুষকে সচেতন হতেই হবে। বরবরই এই একটা বিষয়ে আমরা জোর দিচ্ছি। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।’

চট্টগ্রামে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর পর গত বছর বেসরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে সাতটি আইসোলেশন সেন্টার ও একটি ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। সেসব আইসোলেন সেন্টার ও ফিল্ড হাসপাতালে প্রায় সাড়ে ৭শ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কিন্তু, সংক্রমণ কিছুটা কমে যাওয়ায় গত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে এসব আইসোলেশন সেন্টার ও ফিল্ড হাসপাতাল বন্ধ করার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু, গত মার্চ মাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে করোনার ঊর্ধ্বগতি দেখা দিলেও এসব স্বাস্থ্য অবকাঠামো নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তাই প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি থাকলে তা দ্রুততম সময়ে পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার জন্য আগের তুলনায় আরও বেশি প্রস্তুতির প্রয়োজন হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তারা।

এমএহক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!