দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি রাজস্ব কম হওয়ার কারণ?

গত অর্থ-বছরে কাস্টম হাউজে রাজস্ব ঘাটতি ১৩ হাজার ৮ শ ৮৫ কোটি টাকা

জাতীয় নির্বাচন, জাতীয় বাজেট, ঈদের টানা ছুটি, বেশি রাজস্বের পণ্য আমদানি কমে যাওয়াই দায়ী। এছাড়াও কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা বলছেন বর্তমান ও সাবেক কমিশনারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কারণে সুবিধা করতে না পেরে আমদানি কমিয়ে দেওয়া এবং পণ্য চালান আটকে থাকার কারণে কমে গেছে রাজস্ব আদায়ের হার।

গত অর্থ-বছরের যে কোন মাসের চেয়ে সবচেয়ে কম রাজস্ব আদায় হয়েছে জুন মাসে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আদায় কম হয়েছে ১ হাজার ৪ শ ৩৬.৫৮ কোটি টাকা।

অর্থ-বছরের শেষ মাসে সর্বনিম্ন রাজস্ব আদায় সম্পর্কে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, ঈদের টানা ছুটি, জাতীয় বাজেটে এটি (এডভান্স ট্যাক্স) এর কারণে আমদানি কমে যায়। ফলে অর্থ বছরের শেষ মাসের লক্ষ্যমাত্রার তারতম্যের ব্যবধান বেশি হয়।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে বিগত যে কোন অর্থ-বছরের চেয়ে ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে রাজস্ব কম আদায় হওয়াকে ভিন্নভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন কাস্টমস সংশ্লিষ্টরা।

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে চোরাচালন রোধ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিকেও রাজস্ব কম আদায় হওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অনেকেই।

কাস্টম হাউজ সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, বর্তমান কমিশনার ফখরুল আলম এবং তার আাগের কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে চোরাচালন রোধ, মিথ্যে ঘোষণায় পণ্য আমদানি বন্ধ, ঘোষণার চেয়ে বেশি পণ্য আমদানিসহ সকল অনিয়ম প্রতিরোধে কঠোর অবস্থান নেন। দুর্নীতিবাজদের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকে নিয়ম নীতির মধ্যে আনার চেষ্টা করছেন। এর ফলশ্রুতিতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে আটকে যায় হাজার হাজার কনসাইনমেন্ট (চালান)। সেসব চালান এখনো আটকে আছে চট্টগ্রাম বন্দরে। এসব পণ্য খালাস না হওয়ায় সরকারের রাজস্ব আটকে আছে।

অন্যদিকে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে আগের মতো সুবিধা করতে না পেরে আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন আমদানিকারকরা। এমন অভিযোগ খোদ সিএন্ডএফ এজেন্টসহ বেশ কয়েকজন আমদানিকারকের। তারা শুল্ক ফাঁকি দিতে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাস না করে ঢাকার পাঁনগাও আইসিডিতে পণ্য খালাস শুরু করেছেন।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের কমিশনার সদ্য বিদায়ী কমিশনার কাজী মোস্তাফিজুর রহমান রাজস্ব কম আদায় হওয়ার প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, গাড়ি আমদানি কমে যাওয়া, জ্বালানি তেলের আমদানি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী না বাড়া, বন্ড সুবিধায় পণ্য আমদানিকে রাজস্ব কম আদায় হয়।
বর্তমান কমিশনার ফখরুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজকে সৎ ব্যবসায়ী বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে তিনি কাজ করছেন। এখানে দুর্নীতি এবং প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে কেউ পার পাবে না।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ হাজার ৮ শ ৮৫ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরে অর্জিত এই লক্ষ্যমাত্রা অন্য যে কোন অর্থ-বছরের চেয়ে তুলনামুলকভাবে অনেক কম। ওই অর্থ-বছরে রাজস্ব কম আদায় হওয়ার পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের হারও ছিলো বিগত অর্থ-বছরগুলোর চেয়ে কম। গত অর্থ-বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিলো ৫৭ হাজার ৪ শ ৬২.৭৯ কোটি টাকা। এই লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৪৩ হাজার ৫ শ ৭৭.৩৫ কোটি টাকা। রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ১৩ হাজার ৮ শ ৮৫. ৪৪ কোটি টাকা। ২০১৭ -১৮ অর্থ-বছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিলো ৪২ হাজার ৩ শ ৪৪.৩৯ কোটি টাকা। ওই অর্থ-বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিলো ১৫.৫১ ভাগ।’

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থ-বছরের শুরুতে গত বছরের জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৩ শ ৭৩.৮৩ কোটি টাকা। আদায় হয়েছিলো ৩ হাজার ৩ শ ১১.৯৩ কোটি টাকা। আগস্ট মাসের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৬ শ ৫৩ .৪৭ কোটি টাকা, আদায় হয় ৩ হাজার ৪ শ ৬০.৫৫ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৩ হাজার ৯ শ ৮.৬৭ কোটি টাকা, আদায় হয় ৩ হাজার ৬ শ ৭১. ২২ কোটি টাকা। অক্টোবর মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৭ শ ১৯.৬ কোটি টাকা, আদায় হয় ৩ হাজার ৭ শ ৪২.৭২ কোটি টাকা। নভেম্বর মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ হাজার ৩ শ ১.৬৮ কোটি টাকা আদায় হয় ৩ হাজার ৮ শ ১১.০৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৭ শ ৬৬.৭৫ কোটি টাকা, আদায় হয় ৩ হাজার ৩ শ ৬০.৩৯ কোটি টাকা।

চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ হাজার ১২ কোটি টাকা, আদায় হয় ৪ হাজার ১ শ ৬৪.৯৯ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৩ শ ৪০.৫৮ কোটি টাকা আদায় হয় ৩ হাজার ৩ শ ৫২.৭৭ কোটি টাকা। মার্চ মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৮ শ ৮০.৬২ কোটি টাকা, আদায় হয় ৩ হাজার ৫ শ ৪৩.৪৪ কোটি টাকা। এপ্রিল মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ হাজার ৫ শ ৫৫.২২ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৪ হাজার ২ শ ৯২.৭৯ কোটি টাকা। মে মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫ হাজার ৪ শ ৪৪.৩৮ কোটি টাকা, আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৭ শ ৯৬.৭ কোটি টাকা। সর্বশেষ জুন মাসে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৪ হাজার ৫ শ ৫.৯৯ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৬৯.৪১ কোটি টাকা।

এসসি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!